বাংলাদেশে করোনাভাইরাস প্রথম শনাক্ত হওয়ার পর থেকে ৪৫ দিন পেরিয়ে গেছে। এ পর্যন্ত দেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয়েছে চার হাজারের বেশি।
বৃহস্পতিবার সংবাদ সম্মেলনে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করে বলেন, এই সময়ে বিশ্বের অন্য দেশে যে হারে সংক্রমণ ছড়িয়েছিল তার তুলনায় বাংলাদেশে সংক্রমণের সংখ্যা কম। তিনি বলেন , ‘‘প্রথম করোনাভাইরাস শনাক্ত হওয়ার পর ইতালিতে ৪৫ দিনে আক্রান্ত হয়েছিল এক লাখ ৩০ হাজার। মারা গিয়েছিল প্রায় ১১ হাজার। স্পেনে একই সময়ে আক্রান্ত হয়েছিল ১ লাখ এবং মারা গিয়েছিল ১০ হাজার। যুক্তরাষ্ট্রে আক্রান্ত হয় ১ লাখ ২০ হাজার এবং মারা যায় ২৪ হাজার। সে তুলনায় বাংলাদেশের প্রথম ৪৫ দিনের অবস্থান ভালো।’’
৭ই এপ্রিল কর্মকর্তাদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও এপ্রিল মাস নিয়ে আশংকা প্রকাশ করেছিলেন। তখন তিনি বলেছেন, ‘‘করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী প্রলয় সৃষ্টি করেছে। সারাবিশ্বে যেভাবে করোনা রোগী বৃদ্ধি পেয়েছে, আমাদের এখানেও বৃদ্ধি পাওয়ার একটা ট্রেন্ড আছে। তাতে আমাদের সময়টা এসে গেছে, এপ্রিল মাসটা। এই সময় আমাদের খুব সাবধানে থাকতে হবে।’’
এ বিষয়ে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নাসিমা সুলতানা বলেন, এক মাস আগেও বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ছিল মাত্র ৬ জন। আর এখন এই সংখ্যা চার হাজার ছাড়িয়েছে। তো সংক্রমণের দিক থেকে দেখতে গেলেও এপ্রিল মাসটি ক্রিটিক্যাল ছিল। বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে আক্রান্ত ব্যক্তির সংখ্যা বেশ কয়েক দিন ধরেই তিনশ বা চারশর মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে। প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, তাহলে কি এপ্রিল মাস ক্রিটিক্যাল ছিল না? তবে করোনাভাইরাস সংক্রমিত বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে তুলনা করলে যে ধারণাটি পাওয়া যায় তা হলো এই সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ার কথা ছিল। একটা পর্যায়ে এসে এ সংখ্যা প্রতিদিন এক হাজার কিংবা দুই হাজারও হতে পারতো। এই সংখ্যাটি কেন বাড়ছে না সে বিষয়ে চিন্তার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
বাংলাদেশ স্বাস্থ্য মন্ত্রনালয়ের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বে-নজীর আহমেদ বলছেন, ‘‘বাংলাদেশে টেস্ট করানোর মেকানিজমটা এতো দিনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার কথা ছিল এবং সেটা পুরোপুরি সচল হওয়া দরকার ছিল। এই পরীক্ষার মেকানিজম কতটা সচল সেটা একটা প্রশ্ন।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘যে নমুনাগুলো পরীক্ষা করা হচ্ছে বা যারা লক্ষণ নিয়ে পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন তারা যদি করোনাভাইরাস সংক্রমিত না হয়ে থাকেন তাহলে বলা হচ্ছে যে তার করোনা নেই। কিন্তু তাহলে তার মধ্যে লক্ষণগুলো অন্য কী কারণে দেখা দিয়েছে সে বিষয়টি আর পরিষ্কার করা হচ্ছে না।’’ করোনাভাইরাসের পরীক্ষায় নেগেটিভ আসার অনেকগুলো বিষয় রয়েছে। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলে নমুনা সংগ্রহ করা। এ বিষয়ে ডা. বে-নজীর আহমেদ বলেন, ‘‘নমুনা যখন সংগ্রহ করা হচ্ছে, সেগুলো সংরক্ষণ, পরিবহন এবং পরীক্ষার জন্য ডিএনএ এক্সট্র্যাক্ট করা হচ্ছে সেই জায়গায় কোন ঘাটতি আছে কিনা সেটা একটা ইস্যু।’’
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, পরীক্ষা করার সুযোগ মানুষ কতটা পাচ্ছে। অবশ্য আগের তুলনায় বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এর পরীক্ষার সংখ্যা কিছুটা বেড়েছে। আগে মাত্র একটি ল্যাবে হলেও এখন ২১টি ল্যাবে এই পরীক্ষা হচ্ছে। তবে বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, এসব ল্যাবে পরীক্ষা করানোর সুযোগ সাধারণ মানুষ কতটা পাচ্ছে। যাদের মধ্যে লক্ষণ বা উপসর্গ রয়েছে তারা পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন কি না বা তাদের মধ্যে কোন স্টিগমা আছে কি না সে বিষয়টি নিয়েও ভাবতে হবে। অনেকেই রয়েছেন যারা সামাজিকভাবে হেনস্থা হওয়ার ভয় থেকেই পরীক্ষা করাতে যাচ্ছেন না।
আরেকটি বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশে অনেকের মধ্যেই করোনাভাইরাস শনাক্ত হচ্ছে যাদের মধ্যে কোন উপসর্গ নেই। একই ধরণের ধারা দেখা যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশ ভারতেও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এর কারণে আমাদের দেশের অনেক আক্রান্তের সংখ্যা পাওয়া যাচ্ছে না কারণ তাদের মধ্যে ভাইরাসের উপস্থিতি থাকলেও কোন লক্ষণ নেই। ডা. বে-নজীর আহমেদ বলছেন, ‘‘এই কারণেই যে পরিমাণ রোগী রিপোর্টেড হওয়ার কথা ছিল সেটা হচ্ছে না। কারণ আন্ডার রিপোর্টিংটা বেশ বেশি।’’ তিনি আরও বলেন, ‘‘বলা হয়ে থাকে যে যত রোগী রিপোর্টেড হয় তার আট গুন রোগী এমনিতেই থাকে।’’
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো সময় ক্রিটিক্যাল কিনা সেটা দুই ভাবে দেখা যায়। একটি হচ্ছে সংক্রমণের সংখ্যা কতটা শনাক্ত হচ্ছে সেটা। আরেকটি হচ্ছে, এই সময়ে সংক্রমণ মোকাবেলায় কতটা পদক্ষেপ বা প্রস্তুতি নেয়া হয় সেটা। এই দুটো দিক থেকেই এপ্রিলটা ক্রিটিক্যাল অবশ্যই ছিল। কারণ এ সময়টাতেই লকডাউন করে আন্ত:জেলা যোগাযোগ বন্ধ করা হয়েছে। মানুষের যাতায়াত এবং রাস্তাঘাটে তাদের অবস্থান কম চোখে পড়েছে। মানুষ ঘরে থেকেছে। পরিবহন ব্যবস্থা বন্ধ করা হয়েছে। সে হিসেবে লকডাউনটা বেশ ভাল কাজ করেছে এবং এটা বেশ ভাল পদক্ষেপ ছিল। আর এ কারণেই ঢাকা থেকে সংক্রমণ গ্রামে তেমন একটা পৌঁছাতে পারেনি। তবে একই এলাকার মধ্যে মানুষের চলাচল বা মানুষের কাছাকাছি আসার সুযোগ খুব বেশি একটা নিয়ন্ত্রণ করা যায়নি। যার কারণে ভেতরে ভেতরে সংক্রমণ হয়েছে বলে বিশেষজ্ঞরা আশংকা প্রকাশ করছেন।
বিশেষজ্ঞরা ধারণা করছেন, মে মাসের প্রথম দিকে পিক ( সর্বোচ্চ সংক্রমণের সংখ্যা) পাওয়া যাবে না। এটা আরো প্রলম্বিত হবে। তারা মনে করেন, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যখন পুরোপুরি সচল হবে এবং পরিবহন ব্যবস্থা যখন চালু হবে, তখন বোঝা যাবে যে আসলে সংক্রমণ কতটুকু বাড়ছে। তখন কোয়ারেন্টিন, আইসোলেশন এবং চিকিৎসকদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার বিষয়টি সামনে আসবে।
সর্বোচ্চ সংক্রমণের সংখ্যা (পিক) মে মাসে হবে নাকি সেটি জুন মাস নাগাদ হবে? বিশেষজ্ঞদের কাছে এটি এক বড় প্রশ্ন। পিক আসলেও সেটা কতটা উচ্চতায় উঠবে? সামনের দিনগুলোতে এগুলো বড় ইস্যু হয়ে দাঁড়াবে বলে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন। এজন্যই তাদের দৃষ্টিতে মে মাসটি ক্রিটিক্যাল হতে পারে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান সাইফুল্লাহ মুনশি বলেন, করোনাভাইরাসের সংক্রমণ নিয়ে বাংলাদেশে কোন প্রজেকশন করা হয়নি। তিনি বলেন, ‘‘একটা দেশের মধ্যে ডেমোগ্রাফি, স্বাস্থ্য সুবিধা এবং এপিডেমিওলজিক্যাল তথ্যের ভিত্তিতে একটা কার্ভ তৈরি করা হয়। যার মাধ্যমে জানা যায় যে, রোগের পিকটা কখন হবে।’’ তার মতে, ‘‘বাংলাদেশে এটা করা হলে, এপ্রিল, মে নাকি কোন সময় পিকটা হবে তার ধারণা পাওয়া যেতো। কিন্তু আমাদের সেটা করা হয়নি। মে মাসকে ক্রিটিক্যাল ধরতে হবে কারণ বর্তমানে সংক্রমণের সংখ্যা যে হারে বাড়ছে, সে হারেই যদি বাড়তে থাকে তাহলে মনে হচ্ছে যে, মে মাসে গিয়ে হয়তো একটা পিকে পৌঁছে যাবে।’’ কারণ এখন প্রতিদিনই চারশ-পাঁচশ জন আক্রান্ত হচ্ছে। এটা আরো বাড়বে বলেও আশঙ্কার কথা জানান মিস্টার মুনশি।