ফরাসিরা বরাবরই খ্যাপাটে, রোমান্টিক জাতি হিসেবে স্বীকৃত। অদ্ভুত কাজকর্মের জন্য তাদের খ্যাতি বিশ্বজুড়ে। প্যারিসের কাছে অরলি বিমানবন্দরে পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের ৭২০বি ফ্লাইটটি মাত্রই রানওয়েতে যাচ্ছিল, টেকঅফের জন্য। এরকম সময়ে বিমানের ককপিটে পিস্তল হাতে ঢুকে পড়ে এক ফরাসি যুবক। একহাতে শক্ত করে ধরে রেখেছে তার আর টেপ পেঁচানো ব্যাগ। সেই ব্যাগ আর আরেক হাতের পিস্তল দেখিয়ে ইঞ্জিন বন্ধ করতে বলে পাইলটকে। পাইলট বুঝতে পারেন তার বিমান ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছে।
প্রথমে পাইলটের সাথে আর এরপরে গ্রাউন্ড স্টেশনের সাথে কথা বলায় সবাই বুঝতে পারে, এই পাগলের সাথে কোন সন্ত্রাসী সংগঠনের সংশ্লিষ্টতা নেই। কোন বড় নেতার মুক্তি কিংবা অর্থকড়ি কিছুই চাচ্ছে না সে। তার দাবি খুবই অদ্ভুত। এই পিআইএ ফ্লাইটে করেই ২০ টন চিকিৎসা সামগ্রী পাঠাতে হবে যুদ্ধপীড়িত বাংলাদেশে। আর নয়তো এই বিমান কোথাও যেতে দেবে না সে।
বোকা এই তরুণের নাম জ্যাঁ ইউজিন পল ক্যা। ১৯৭১ সাল, মার্চের পর থেকেই সারা পৃথিবী জানতে শুরু করে নিরীহ বাঙ্গালির উপর কি নির্মম অত্যাচার চালাচ্ছে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। ভারতের শরনার্থী শিবিরে চিকিৎসার অভাবে, ওষুধের অভাবে মারা যাওয়া মানুষের কাতরতা ততদিনে সারাবিশ্বের সবার মত তার প্রাণেও নাড়া দিয়েছিল। কিছু একটা করতেই হবে এই ভাবনা থেকেই প্লেন হাইজ্যাকের পরিকল্পনা করে সে।
প্লেনের কোন যাত্রীকে জিম্মি করলো না সে। একে একে সবাইকে নেমে যেতে দিয়েছে। বোমা সদৃশ ঐ ব্যাগের মধ্যে ছিল কেবল একটা বাইবেল আর দুইটা ডিকশনারি। বাইরে থেকে তার পেঁচিয়ে রেখেছিল শুধু মানুষকে ভয় দেখানোর জন্য। এই দেখিয়ে সাত ঘণ্টা আটকে রাখল প্লেনটাকে। ফরাসি সরকার তখন রাজি হয় এই জরুরি চিকিৎসা সামগ্রী বিমানে লোড করবার জন্য। পেনিসিলিন কার্গোতে নিলে নষ্ট হয়ে যাবে এই কথা বলে ককপিটে রাখার ব্যাপারে রাজি করায় জ্যাঁঁ ক্যা-কে। কিন্তু ঐ ওষুধ পরিবহন কর্মীরা আদতে ছিল ফরাসি পুলিশের দল। তারাই ওষুধ রাখার ছলে ককপিটে যেয়ে জাপটে ধরেন জ্যাঁঁ ক্যা কে।
বিমান ছিনতাই এর মামলায় শাস্তি হিসেবে পাঁচ বছরের জেল হয় তার। কিন্তু ফরাসি সরকার নৈতিক ভাবে সিদ্ধান্ত নেয় বাংলাদেশকে সাহায্য করবার। ভারতের আশ্রয় শিবিরে এসেছিল সেই ২০ টন ওষুধ আর চিকিৎসা সামগ্রী। পুরো ঘটনা আলোড়ন তোলে ইউরোপিয়ান ও আন্তজার্তিক সংবাদমাধ্যমগুলোতে। এমনকি পাকিস্তানের যুদ্ধবিরতির প্রস্তাবেও বন্ধুরাষ্ট্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সমর্থন না করে ভোটদানে বিরত থাকে ফ্রান্স।
আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের বন্ধু জ্যাঁ ইউজিন পল ক্যা ২০১২ সালের ২৩ ডিসেম্বরে প্রায় ৬৯ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন। তিনি তার মহৎ কাজের মাধ্যমে বিশ্বের সকল নিপীড়িত মানুষের কাছে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।