স্বল্প পুঁজিতে অধিক মুনাফা লাভের কারণে বান্দরবানে মাশরুম চাষে আগ্রহী হয়ে উঠেছেন বেকার নারী জনগোষ্ঠী। পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ ও সুস্বাদু মাশরুম চাষ করে ইতোমধ্যে বান্দরবানে অনেক নারী স্বাবলম্বী হয়েছেন। বান্দরবান শহরের বালাঘাটা হর্টিকালচার সেন্টারের সহায়তা নিয়ে ইতোমধ্যে গ্রীণহোম মাশরুম এন্ড এগ্রো ফার্ম, ছেনুয়ারা মাশরুম ফার্ম, বাবু মাশরুম ফার্মসহ আরো কয়েকটি খামার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এছাড়াও ব্যক্তি উদ্যোগে অনেকেই গড়ে তুলেছেন শখের মাশরুম খামার। এতে পারিবারিক ভাবে আমিষের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি অতিরিক্ত মাশরুম বাজারে বিক্রি করে বাড়তি উপার্জন করছেন উদ্যোক্তারা।
বান্দরবান হর্টিকালচার সেন্টারের উপ পরিচালক কৃষিবিদ মোঃ মিজানুর রহমান জানান, মাশরুম একটি অর্গানিক খাবার। বাজারে মাশরুমের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। মাশরুম চাষ সম্প্রসারণের লক্ষ্যে হর্টিকালচার সেন্টার থেকে সুলভ মূল্যে স্পুন ও মাদার কালচার চাষী পর্যায়ে সরবরাহ করা হচ্ছে। এ স্পুন দিয়ে অনেক উদ্দ্যোক্তাই মাশরুম খামার গড়ে তুলেছেন। তিনি জানান, আগ্রহী চাষীদের অফিস চলাকালীন মাশরুম চাষের উপর কারিগরি পরামর্শ দেয়া হচ্ছে। এছাড়াও বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কর্মশালার মাধ্যমে চাষীদের মাশরুম চাষে দক্ষতা বৃদ্ধির কার্যক্রম অব্যাহত আছে। তিনি জানান, চাষীদের হাতে কলমে শিখানোর জন্য ঢাকাস্থ মাশরুম উন্নয়ন ইন্সটিটিউটের উপ পরিচালক কৃষিবিদ ড. নিরোধ চন্দ্র সরকার ও একই প্রতিষ্ঠানের মাশরুম বিজ্ঞানী কৃষিবিদ ড. আখতার জাহান কাকনসহ বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে একটি প্রশিক্ষণ কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বান্দরবানে প্রতিদিন ১০০ কেজি মাশরুম চাহিদার বিপরীতে বাজারে সরবরাহ আছে ৭৫ কেজির মতো। এরমধ্যে ৫০ কেজি আসে রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলা থেকে । চাহিদার অবশিষ্ট ভাগ বান্দরবানের চাষীদের উৎপাদন থেকে মিটানো হয়। বান্দরবান বাজারে বর্তমানে ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা কেজি দরে মাশরুম বিক্রি হচ্ছে। শহরের মধ্যমপাড়াসহ মহিলা ক্লাব মার্কেটে অবস্থিত প্রাকৃতিক খাদ্য ভান্ডার ও অর্গানিক শস্য ভান্ডারে প্রতিদিনই মাশরুম বিক্রি হয়।
চাষীরা জানান, মাশরুম চাষ করতে কোন জমির প্রয়োজন হয় না। ছায়াযুক্ত স্যাঁতস্যাঁতে ঘরই মাশরুম চাষের জন্য উপযুক্ত স্থান। খরা, বন্যাসহ প্রাকৃতিক দুর্যোগে মাশরুম খামারের কোন ক্ষতি হয় না। এছাড়া মাশরুম চাষের জন্য খামারে কোন খাদ্য দিতে হয় না। প্রতিদিন তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বজায় রেখে খামারে ২ থেকে ৪ বেলা পরিস্কার পানি স্প্রে করলেই মাশরুম চাষকে লাভজনক পেশায় রূপ দেয়া যায় ।
বান্দরবান হর্টিকালচার সেন্টারের উপসহকারী উদ্যান কর্মকর্তা অধীন চন্দ্র দে জানান, মাশরুম হলো এক ধরনের ভক্ষণযোগ্য মৃতজীবী ছত্রাকের ফলন্ত অংগ। জারণ বিজারণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মাশরুমের জীবনচক্র আবর্তিত হয়। তিনি বলেন, গ্রামীণ নারীদের আর্থিক সমৃদ্ধির লক্ষে ব্যবসায়িক ভিত্তিতে মাশরুম চাষ কৃষিক্ষেত্রে নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে। কৃষির বর্জ্য পদার্থ যেমন খড়, গাছের শুকনো পাতা, ধানের কুঁড়ো/তুষ, কাঠের ভুষি প্রভৃতি মাশরুম চাষের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হয়। যা গ্রামীণ এলাকায় প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। সঠিক পরিচর্যা করলে প্রতিটি স্পুন বা খড়ের প্যাকেট থেকে ৩ মাস পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।
পুষ্টিবিদদের মতে, মাশরুম বেকারত্ব ঘুচানোর পাশাপাশি পুষ্টির চাহিদা বিমোচনে সাহায্য করতে পারে। পুষ্টি বিচারে মাশরুম নিঃসন্দেহে সেরা খাবার। মাশরুম ঔষধি গুণ বলে শেষ করার মতো নয়। “গরীবের মাংস” হিসেবে পরিচিত মাশরুম খনিজ উপদান, ভিটামিন বি-কমপ্লেক্স এবং ১৮ রকমের অ্যামাইনো এসিডে পরিপূর্ণ। মাশরুম সহজপাচ্য হওয়ায় শিশু, গর্ভবতী মহিলা, বৃদ্ধ এবং হার্টের রোগী, বহুমুত্র (ডায়াবেটিস) গ্যাসের সমস্যা, কোষ্ঠকাঠিন্য, হাইপারটেনশন এবং রক্তস্বল্পতা রোগীদের ক্ষেত্রে একটি উত্তম পথ্য হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। আমাদের প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় যেসব উপাদান অতি প্রয়োজনীয় যেমন প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেল সেগুলো মাশরুমে উচুঁ মাত্রায় আছে। অন্যদিকে যেসব খাদ্য উপাদানের আধিক্য আমাদেরকে জটিল মরণব্যাধির দিকে নিয়ে যায়, যেমন ফ্যাট ও কার্বোহাইড্রেড তা মাশরুমে নেই বললেই চলে। মাশরুমকে তাজা ও শুকনো অবস্থায়ও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে খাওয়া যায়।
কৃষিবিদদের মতে, মাশরুম অত্যন্ত সুস্বাদু সবজি। প্রাচীনকাল থেকে মানুষ মুখরোচক এই মাশরুমের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে খাদ্য তালিকায় মাশরুমকে অগ্রাধিকার দিয়ে আসছে। এমনকি রাষ্ট্রীয় অতিথিদের আপ্যায়নে ব্যবহৃত হতো অসাধারণ লোভনীয় স্বাদের মাশরুম। বিশ্বব্যাপী ভোজন রসিকরা মাশরুমকে স্বর্গীয় খাবারের সাথে তুলনা করে। মাশরুম শুধু নিজেই সুস্বাদু খাবার নয়, মাশরুম অন্য খাবারের সাথে ব্যবহার করলে তার স্বাদ বহুগুণে বেড়ে যায়। তাই মাশরুমকে বলা হল পরশস্বাদু খাবার।
বান্দরবানের মাশরুম চাষীরা জানান, বাড়িতে বসে মাশরুম চাষ একটি উপযুক্ত জীবিকা। অবসর সময়ে বাড়ির অন্যান্য সদস্যরাও এ কাজে সহযোগিতা করতে পারেন। যে সমস্ত শিক্ষিত যুবক-যুবতী বেকারত্বের অভিশাপে জর্জরিত, প্রচলিত সামাজিকতার কারণে শিক্ষিত হবার পরও যারা রোদে পুড়ে, ফসলের মাঠে কাদামাটির সাথে মিশে নিজেদেরকে প্রচলিত উৎপাদন পদ্ধতিতে সম্পৃক্ত করতে অনীহা প্রকাশ করেন, সে সমস্ত বেকার যুবকদের জন্য মাশরুম চাষ একটি আর্শীবাদ হতে পারে। কারণ মাশরুম চাষ করতে রোদে পুড়তে হয় না, কাদামাটির সংস্পর্শে আসার প্রয়োজন নেই, ঘরের মধ্যে তাকে তাকে কিংবা শিকায় সাজিয়ে সামান্য শ্রমে অল্প সময়ে ন্যুনতম পুঁজিতে অধিক এবং স্বাধীন উপার্জন করা সম্ভব। যেহেতু মাশরুম উচ্চবিত্তের সৌন্দর্যচর্চা ও সৌখিন খাবারের উপকরণ, তাই মাশরুম চাষ অত্যন্ত মর্যাদাকর পেশা হিসেবেই সকলের কাছে গ্রহণযোগ্য। যেখানে শিক্ষিত যুবক-যুবতীরা কোন রকম হীনমন্যতায় না ভুগে গর্বিতচিত্তে মাশরুম চাষে আত্মনিয়োগ করতে পারবেন। সুতরাং বাংলাদেশে মাশরুম চাষ মানেই কর্মহীনদের জন্য আছে বেকার সমস্যা সমাধানের এক উজ্জ্বল সম্ভাবনা।
বাংলাদেশের জনসংখ্যার অর্ধেক নারী। অথচ দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাসহ নানাবিধ কারণে নারীদের একটি উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সংখ্যায় শ্রমের সু-ব্যবস্থা না থাকার উপার্জন বিমুখ। ফলে দেশের অর্ধেক কর্মক্ষম জনশক্তি উন্নয়নের কাজে সম্পৃক্ত নয়। গ্রামীণ নারীরা সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এনজিও সংস্থার নিকট থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেই মাশরুম খামার স্থাপন করতে পারেন। গৃহস্থালির অন্যান্য কাজের ফাঁকে ফাঁকে মাশরুম খামার পরিচর্যা করতে পারলেই আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হওয়া যায়। যে সকল নারীরা বাড়িতে অবসর সময়কে কাজে লাগিয়ে নিজেদের স্বনির্ভর এবং আর্থিক ভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করতে চান তাদের জন্য মাশরুম চাষ একটি নতুন দিগন্ত খুলে দিতে পারে।
গ্রামীণ নারীদের স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে ছোট ব্যবসায়িক উদ্যোগ হিসেবে মাশরুম চাষের সম্ভাবনা অপরিসীম। বিভিন্ন সরকারি এবং বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যারা নারীদের স্বনির্ভরতার লক্ষ্যে কাজ করে চলেছেন, তারা মাশরুম চাষকে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে এগিয়ে আসতে পারেন।
মাশরুমের বিভিন্ন ব্যবহারিক কৌশলকে কাজে লাগিয়ে অর্থ্যাৎ ভেল্যু এড করে কম বয়সী শিক্ষিত বেকার নারীরা মাশরুম থেকে বিভিন্ন দ্রব্যসামগ্রী যেমন-আচার, শুকনো মাশরুমের গুড়া, মাশরুমের বিস্কুট ইত্যাদি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করে ব্যবসার পরিমাণ বড় করে তুলতে পারেন। এছাড়াও হোটেল রেষ্টুরেন্টে মাশরুমের মজাদার রেসিপি তৈরি করেও ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সুনাম সম্প্রসারণ করতে পারেন। মাশরুমের বাজারমূল্য ও চাহিদা নারীদের নতুন উদ্যমে কাজ করতে অনুপ্রেরণা জোগাবে।
মাশরুম সংরক্ষণ করাও খুবই সহজ। খামার থেকে উত্তোলিত মাশরুম ব্যাগে বায়ুরোধ করে ফ্রিজের নরমাল চেম্বারে ৫ থেকে ১০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ৭/৮ দিন রেখে খাওয়া যায়। ফ্রিজ থেকে বের করে প্যাকেটের সব মাশরুম এক সাথে রান্না করতে হবে। পারিবারিক চাহিদা মোতাবেক ছোট ছোট প্যাকেটে বায়ুরোধ করে ফ্রিজে সংরক্ষণ করা ভালো। শুকিয়েও মাশরুম সংরক্ষণ করা যায়। শুকনো মাশরুম ব্যান্ডারে গুড়ি করে বায়ুরোধী কৌটায় ৬/৭ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যায়।
বাংলাদেশে বড় শহরগুলোর বিভিন্ন হোটেল সুপার শপগুলোতে ও চায়নিজ হোটেল গুলোতে মাশরুমের অনেক চাহিদা রয়েছে। যার ফলে মাশরুমের বাজার মূলত শহরে গড়ে উঠেছে। এছাড়াও বিদেশেও এর চাহিদা রয়েছে। ফলে মাশরুম শুকিয়ে বিদেশে রপ্তানি করা সম্ভব।
আমাদের দেশের পার্বত্য চট্টগ্রামে বসবাসরত সকল জনগোষ্ঠী মাশরুম খেতে খুবই অভ্যস্ত। বিশেষ করে ক্ষুদ্র নৃ গোষ্ঠীর জনগণের কাছে মাশরুমের চাহিদা বেশি। এখানে প্রাকৃতিকভাবে জম্ম নেয়া ভক্ষণযোগ্য মাশরুমও বাজারে বিক্রি হয়। বান্দরবান বাজারে সারা বছরই চাষ করা মাশরুম পাওয়া যায়।