ফিটনেসবিহীন গাড়ি বছরের পর বছর সড়কে চললেও তা ধরেন না ট্রাফিক সার্জেন্টরা। কদাচিৎ ধরলেও নানা ফাঁকফোকরে পেয়ে যায় ছাড়। সড়কে ফিটনেসবিহীন গাড়ি ধরার ‘একমাত্র মাধ্যম’ এখন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এমনকি লাইসেন্সবিহীন গাড়ি ও চালকদের বেশিরভাগই ধরা পড়েন মূলতঃ এ আদালতে।
সেই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সুযোগ না রেখেই চূড়ান্ত করা হয়েছে প্রস্তাবিত ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’-এর খসড়া।
শুধু তাই নয়, ফিটনেসবিহীন গাড়ির জরিমানা কমানোর প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়। পাশাপাশি ওজনসীমা (এক্সেল লোড) অতিক্রম করলে গাড়ির মালিক ও চালকের দণ্ড মওকুফের প্রস্তাব করা হয়েছে। তবে বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে দণ্ডবিধির ৩০৪ (বি) ধারা অনুযায়ী ৩ বছরের কারাদণ্ড বাড়িয়ে ৫ বছর করার প্রস্তাব করা হয়েছে। আগে এটিকে ‘জামিনযোগ্য’ বলা হলেও প্রস্তাবিত খসড়ায় ‘অজামিনযোগ্য’ অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে।
এভাবে চূড়ান্ত করা ‘সড়ক পরিবহন আইন-২০১৮’ অনুমোদনের জন্য উপস্থাপন করা হবে আজ সচিবালয়ে অনুষ্ঠিতব্য মন্ত্রিসভা বৈঠকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বৈঠকে সভাপতিত্ব করবেন। একাধিক মন্ত্রী এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন। এ ছাড়া আজকের বৈঠকের আলোচ্যসূচিতে রয়েছে ‘কৃষি বিপণন আইন, ২০১৮’-এর খসড়ার চূড়ান্ত অনুমোদন। গত বছরের ২৭ মার্চ সড়ক পরিবহন আইনের খসড়ায় নীতিগত অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। এরপর চূড়ান্ত অনুমোদনের আগে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের জন্য পাঠায় সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। এরপরই এক প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরোধিতার কারণে হিমাগারে চলে যায় প্রস্তাবিত আইনটি।
২৯ জুলাই রাজধানীতে বাসচাপায় দুই শিক্ষার্থী নিহতের ঘটনায় কয়েকদিন ধরে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। প্রায় অচল হয়ে পড়ে রাজধানীসহ সারা দেশের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা। পরিস্থিতি সামাল দিতে আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিংয়ের নামে দেড় বছরের বেশি সময় পড়ে থাকা ‘সড়ক পরিবহন আইনটি’র খসড়া চূড়ান্তকরণের কাজ গতি পায় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে।
বুধবার আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে জানান, আমরা আইনটি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে দেখার চেষ্টা করেছি। যেসব কারণে দুর্ঘটনা হতে পারে তার বিষয়ে পর্যাপ্ত প্রভিশন করা হয়েছে কিনা, সেগুলো যাতে না ঘটে, সেজন্য পর্যাপ্ত প্রভিশনের মধ্যে আছে কিনা এবং সেখানে আইনের কোনো ফাঁকফোকর আছে কিনা, সেসব দেখে আইনটা প্রস্তুত করা হয়েছে। এটা অত্যন্ত আধুনিক একটা আইন হয়েছে। আইনটিতে ত্বরিতগতিতে বিচারের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং কোনো অপরাধী ফাঁকফোকর দিয়ে বের হতে পারবে না। প্রধানমন্ত্রী চান, আইনটি দ্রুত পাস হোক এবং মন্ত্রিসভার আগামী বৈঠকে আইনটি অনুমোদনের জন্য তোলা হবে। এছাড়া সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের ও সমাজকল্যাণমন্ত্রী রাশেদ খান মেননসহ কয়েকজন মন্ত্রী আইনটির খসড়া মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের বিষয়টি গণমাধ্যমকে নিশ্চিত করেছেন।
যেসব সংশোধনী প্রস্তাব করা হয়েছে খসড়ায়: মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদনের সময় প্রস্তাবিত নতুন আইনে দুর্ঘটনার জন্য দণ্ডবিধি অনুযায়ী শাস্তি দেয়ার প্রস্তাব করা হয়। দণ্ডবিধিতে তিন রকমের বিধানের মধ্যে নরহত্যা হলে ৩০২ ধারা অনুযায়ী মৃত্যুদণ্ডের সাজা। খুন না হলে ৩০৪ ধারা অনুযায়ী যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও বেপরোয়াভাবে গাড়ি চালিয়ে মৃত্যু ঘটালে ৩০৪(বি) ধারা অনুযায়ী ৩ বছরের কারাদণ্ড হবে। আইনটি প্রণয়নের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, ৩০৪(বি) ধারা অনুযায়ী তিন বছরের স্থলে ৫ বছর কারাদণ্ড এবং এই জামিনযোগ্য অপরাধকে অজামিনযোগ্য করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
এছাড়া ওজনসীমা অতিক্রম (যেমন, ৫ টন ধারণক্ষমতার ট্রাকে এর থেকে বেশি ওজন পরিবহন) করলে গাড়ির মালিক ও চালককে তিন বছরের কারাদণ্ড বা ৩ লাখ টাকা জরিমানার বিধান ছিল নীতিগত অনুমোদনের সময়। প্রস্তাবিত খসড়ায় এ সংক্রান্ত শাস্তি বাদ দেয়া হয়েছে।
ফিটনেসবিহীন মোটরযান ব্যবহার করলে এক বছরের জেল বা সর্বোচ্চ এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছিল নীতিগত অনুমোদনের সময়। তা কমিয়ে ২৫ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ অপরাধে আগের আইনে ছয় মাস জেল বা ১০ হাজার টাকা জরিমানা হতো। এছাড়া প্রস্তাবিত আইনে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সুযোগ রাখা হয়নি। বর্তমানে বিদ্যমান ‘দ্য মোটর ভেহিকেল অর্ডিন্যান্স ১৯৮৩’-তে এ আদালত পরিচালনার সুযোগ ছিল।
আইনজীবী মনজিল মোরসেদ যা বললেন: আইনটি নিয়ে আদালতে রিট করেছিলেন সুপ্রিমকোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। আদালতের পর্যবেক্ষণ যাতে আইনের খসড়ায় পুরোপুরি প্রতিফলিত হয় তা নিশ্চিত করতে রোববার মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সচিবের সঙ্গে দেখা করেন তিনি। এ সংক্রান্ত আদালতের পর্যবেক্ষণের কপিও তাদের কাছে দেন।
পরে মনজিল মোরসেদ যুগান্তরকে বলেন, আমাদের দাবি ফিটসেনবিহীন গাড়ি ডাম্পিংয়ে পাঠাতে হবে। সেখানে তার জরিমানা কমানো মানেই প্রেসার গ্রুপের কারণে করা হয়েছে। আইনে ওজনসীমা অতিক্রম করার শাস্তি ও ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার সুযোগ বাদ দিলে পরিবহন খাতে অরাজকতা আরও বাড়বে। আর দণ্ডবিধির ৩০৪(বি) ধারা অনুযায়ী তিন বছরের স্থলে ৭ বছরের বেশি শাস্তি দেয়ার কথা বলেছেন আদালত। সেটা না করে আরও কমিয়ে আইন করা হলে আদালতের আদেশের প্রতি অশ্রদ্ধা জানানো হবে।
কৃষি বিপণন আইন: কৃষিপণ্য কেনাবেচার সময় পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতারা মূল রসিদ সংরক্ষণ করবেন। কৃষি বিপণন অধিদফতরের কর্মকর্তারা বিক্রেতাদের এসব রসিদ নিয়মিত পরীক্ষা করবেন। বিক্রেতাদের সংঘটিত অপরাধ ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের মাধ্যমে বিচার করা হবে। এসব বিধান রেখে ‘কৃষি বিপণন আইন, ২০১৮’-এর খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার।
আইনটিতে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে অভিযান পরিচালনার বিধান রাখা হয়েছে। প্রক্রিয়াকরণ কৃষিপণ্যের মোড়কে পণ্যের পুষ্টিমান ও উপাদানের শতকরা হার, উৎপাদনের তারিখ ও মেয়াদোত্তীর্ণের তারিখ এবং বিক্রয়মূল্য উল্লেখ করা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। অপরিপক্ব বা অপরিণত ফল পাকানো যাবে না। দুধ, মাছ, মাংস, ফল ও শাকসবজিসহ অন্যান্য কৃষিপণ্য সংরক্ষণের জন্য বা অন্য কোনো উদ্দেশ্যে জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক ব্যবহার করা যাবে না। এ ক্ষেত্রেও সর্বোচ্চ জরিমানা এবং কারাদণ্ডের বিধান প্রয়োগ করা হবে। খসড়া আইনে ব্যবসায়ীরা কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করলে সর্বোচ্চ এক বছরের কারাদণ্ড অথবা এক লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে। পণ্যের ওজনের সঙ্গে মোড়কের ওজন সমন্বয় করলে সর্বোচ্চ ছয় মাসের কারাদণ্ড বা অনূর্ধ্ব এক লাখ টাকা জরিমানার বিধান রাখা হয়েছে।