আমরা অনেক সময়ই কথায় কথায় বলি যে, ‘ভাষা হারিয়ে ফেলেছি’। এটি নিছক একটি অভিব্যক্তি হলেও একবার এর আভিধানিক অর্থ চিন্তা করে দেখুনতো কী দাঁড়ায়! সত্যি যদি এমন কোন দিন আসে যেদিন আসলেই মুখের ভাষা খুঁজে না পাওয়া যায়! ভাবছেন ভাষা আবার কোথায় যাবে? ভাষাও চলে যায়। খুব সাধারণ একটি বিষয়ে আলোকপাত করা যাক। যখন কোন পরিবার নিজ দেশ থেকে অন্য কোন দেশে গিয়ে স্থায়ী হয়, তখন বড়জোর এর পরের প্রজন্ম পর্যন্ত তাদের মাতৃভাষার অনুশীলন হয়। কিন্তু এরপর থেকেই ধীরে ধীরে তৃতীয় প্রজন্মের মুখ থেকে সত্যি সত্যিই তাদের পূর্বপুরুষের মাতৃভাষা হারিয়ে যায়। এমনটা দেশে থাকলেও হতে পারে। বাংলাদেশের অনেক পরিবারেই শিশু সদস্যরা ইংরেজি মাধ্যমে পড়াশোনা করে এবং তারা মুখে কথা বলতে পারলেও বাংলা ভাষা লিখতে বা পড়তে পারেনা। এক্ষেত্রেও ভাষা হারিয়ে যাওয়ার প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়। কিন্তু আদতে ভাষা আরো করুণভাবে হারিয়ে যেতে পারে। হারিয়ে যাচ্ছেও।
পৃথিবীর অনেক অন্চলে যেখানে জাতিবৈচিত্র্য বেশি, সেসব অন্চলের বহু ভাষা বিপন্ন হতে চলেছে। বহু ভাষার ঘটেছে মৃত্যু! ‘ভাষার মৃত্যু’ তখনই ঘটে যখন সেই নির্দিষ্ট ভাষায় কথা বলার মত আর কেউ থাকেনা। সেই ভাষা নিয়ে গবেষণা চললেও সেটিকে মৃত ভাষাই বলা হবে।
ইউনেস্কোর গবেষণা অনুসারে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫০ সাল থেকে থেকে ২০১০ সালের মধ্যে ২৩০টি ভাষা হারিয়ে গেছে। প্রতি দুই সপ্তাহে একটি করে ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে সেই ভাষা বলতে পারা শেষ মানুষটির মৃত্যুর সাথে সাথে। বর্তমানে পৃথিবীর মোট ভাষার এক তৃতীয়াংশ ভাষায় কথা বলা মানুষের সংখ্যা এক হাজারেরও কম। যখন কোন ভাষা হারিয়ে যায়, তখন তার সাথে সম্পর্কিত গান, সাহিত্য, কলা, লোককথা এসবও হারিয়ে যায় ধীরে ধীরে। এ ক্ষতি অপূরণীয়।
রাজনৈতিক প্রভাব, সংরক্ষণের অভাব, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং বিশ্বায়নের কবলে পরে ভাষার এ ক্ষতি হয়। বিংশ শতাব্দিতে পৃথিবীজুড়ে অনেক রাষ্ট্র তাদের দেশের মানুষের উপর অন্যান্য ভাষা বিভিন্নভাবে এমনকি জোর করেও চাপিয়ে দিয়েছে। অস্ট্রেলিয়ায় ইউরোপ থেকে অভিবাসীর আগমনের ফলস্বরূপ প্রায় একশত আদি ভাষা এখন বিলুপ্তির পথে। চীন তিব্বত দখলের অর্ধশত বছরের মাঝে প্রায় এক ডজন আঞ্চলিক ভাষা অক্ষরসহ বিলুপ্তির পথে।
যুক্তরাষ্ট্র ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান উইকিটাং (wiki tongue) বিলুপ্তপ্রায় ভাষা সংরক্ষণের প্রয়াসে পৃথিবীজুড়ে ৪০ টি দেশের সেচ্ছাসেবীর সমন্বয়ে একটি নেটওয়ার্ক স্থাপন করেছে। এই স্বেচ্ছাসেবীরা স্থানীয় বাসিন্দাদের মুখের ভাষা অতীত, বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ কালের অভিব্যক্তি দিয়ে রেকর্ড করে রাখবেন। যেন পরবর্তিতে এসব ভাষার উপর গবেষণা চালু রাখা যায়। এই কাজ চলাকালীন যেমন অনেক অজানা ভাষার সন্ধান পাওয়া গেছে তেমনি উপলব্ধি করা গেছে ভাষা হারানোর করুণ বাস্তবতা। যেমন রাশিয়ার ‘সামি’ ভাষাভাষি একজন তার রেকর্ড করার ঠিক আগ মুহূর্তে মারা যান। আর তার মৃত্যুর সাথে সাথেই চিরতরে হারিয়ে যায় রাশিয়ার প্রত্যন্ত আন্চলিক এই ভাষাটি।
বিলুপ্তপ্রায় Gottscheerisch ভাষা বলতে পারা একজন বৃদ্ধ তার মাতৃভাষা হারিয়ে যাওয়ার বেদনা বোঝাতে বলেন, “ভাবুনতো! যে গীটার বাজায় সে যদি তার আঙুলগুলোই আর ব্যবহার না করতে পারেন! আমাদের অবস্থাও হয়েছে তাই। আমার মায়ের ভাষা আমার জানা আছে, কিন্তু তার ব্যবহার নেই। আর চোখের সামনে তাকে একটু একটু করে হারিয়ে যেতে দেখছি!”
মুখ ফুটে আরাম করে নিজের, একেবারেই মায়ের কাছ থেকে শেখা বুলি যদি আওড়াতে না পারা যায়, যদি বেঁচে থাকার দোহাই দিয়ে নিজের একটা স্বত্ত্বাই বিলীন করে দিতে হয়, তাহলে সে বাঁচা কী আসলেই বেঁচে থাকা! তা নয় বলেই পৃথিবীর বুকে ভাষার জন্য প্রাণ দিতে পারা জাতি হিসেবে বাংলাদেশ এর নাম সমুজ্জ্বল হয়ে আছে। সারা বিশ্ব এই ত্যাগ স্মরণ করছে শ্রদ্ধাভরে। কিন্তু এরপরও কী মান রাখতে পারছি নিজের ভাষার! বিকিয়ে কি দিচ্ছিনা, ভেসে কি যাচ্ছিনা অন্য কিছুর আগ্রাসনে! ভাষা বেঁচে থাকে মানুষ দিয়ে, মানুষের কন্ঠে। সেই মানুষ আমরা সমুন্নত রাখি মায়ের ভাষাকে। পৃথিবীর সব ভাষা সুন্দর। সুন্দর ভাষাগুলো বেঁচে থাক। মাতৃভাষা হারিয়ে না যাক!