২০১০ সালের ৭ই নভেম্বর বিএনপির একটি সমাবেশে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার পরিকল্পনার কঠোর সমালোচনা করেছিলেন দলটির চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। এই সমাবেশে মিসেস জিয়া সরকারকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছিলেন, বিনা শুল্কে ট্রানজিট দেয়া হলে তাতে তারা প্রবলভাবে বাধা দেবেন।
এর আগে ও পরে বহু সভা সমাবেশে খালেদা জিয়াসহ দলটির নেতারা ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার বিরুদ্ধে একই ভাষায় বক্তব্য দিয়েছেন।
এমনকি ভারতের পণ্যবাহী কোনও ট্রাক বাংলাদেশের ভেতর দিয়ে যেতে দেয়া হবেনা- এমন ঘোষণাও এসেছিলো বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর কাছ থেকে।
মূলত ট্রানজিটের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরুর আগে থেকে প্রায় এক দশক জুড়ে রাজনীতিতে উত্তাপ ছড়িয়েছে এই ইস্যু এবং সেসময় থেকে শুরু করে গত ২-৩ বছর আগ পর্যন্ত দেশের রাজনীতির একটি বড় ইস্যুই ছিলো ট্রানজিট।
কিন্তু বাস্তবতা হলো এর মধ্যেই ২০১৬ সালের ১৬ই জুন বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিক ট্রানজিট সুবিধা পায় ভারত।
অর্থনীতিবিদ মুস্তাফিজুর রহমান বলছেন ট্রানজিট ইস্যু বরাবরই রাজনীতিকরণের শিকার হয়েছিলো, যদিও এখন আর সে পরিস্থিতি নেই বলেই মনে করেন তিনি।
“এটা বাণিজ্য, বিনিয়োগ, ট্রেড ফ্যাসিলিটি বাড়ায়। এর মাধ্যমে বাংলাদেশের যে উপকৃত হবার বড় সম্ভাবনা আছে তার প্রতিফলন আমরা জনমানুষের মধ্যে দেখছি। ফলে বিরোধী দলও এখন আর এটি হবে কি-না এ প্রশ্ন না তুলে এটা কিভাবে হবে, কিভাবে হলে বাংলাদেশের স্বার্থ সংরক্ষণ হয় ভালোভাবে সেই জায়গায় গেছে। এটা বাংলাদেশের রাজনীতির একটা গুরুত্বপূর্ণ উত্তরণ”।
এবারেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলমান দিল্লী সফরে ট্রানজিট সম্পর্কিত বিশেষ করে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ভারতের ব্যবহার করা নিয়ে চুক্তি বা সমঝোতার কথা জানিয়েছেন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী।
কিন্তু ট্রানজিট নিয়ে যেই বিএনপির প্রবল আপত্তি ছিলো তারা সাম্প্রতিক সময়ে এ বিষয়ে নীরব কেনো?
- ‘মানবিক কারণে’ ভারতকে ফেনীর পানি দিল বাংলাদেশ
- ভারতের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রাপ্তি কী?
- সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া যেভাবে বদলে দিচ্ছে জীবন
- শেখ হাসিনার দিল্লি সফরে তিস্তার জট খুলবে?
এমন প্রশ্নের জবাবে দলটির ভাইস চেয়ারম্যান আব্দুল আউয়াল মিন্টু বলছেন তার দল ট্রানজিটের বিরোধিতা করেনি কখনো। তবে তারা সোচ্চার ছিলেন যাতে করে তার ভাষায় ট্রানজিটের নামে দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত না হয়।
” ভারতের একটা রাজ্য থেকে আমাদের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতের আরেকটি রাজ্যে যাচ্ছে। এটাকে স্বাভাবিক ট্রানজিট বা ট্রান্সশিপমেন্ট বলা যায়না। যে চুক্তিই হোক না কেন বাংলাদেশের স্বার্থ ও নিরাপত্তার বিষয়টিকেও যেনো গুরুত্ব সহকারে আনা হয়। আমরা সেটিই সবসময় বলতে চেয়েছি”।
এখন কোন বিষয় নিয়েই সরকার কথা বলতে দেয়না সে কারণেই ট্রানজিট ইস্যুতেও আলোচনা তেমন একটা নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন দেশের স্বার্থ বিঘ্নিত হলে অবশ্যই তারা কথা বলবেন।
“রাজনৈতিক দলের কাজই হলো মানুষের স্বার্থ নিয়ে কথা বলা। কিন্তু বিএনপি কখনোই ইস্যুগুলো ভুলে যায়নি। প্রতিটি ইস্যুই বিএনপি কেয়ার করে ও কথা বলে। ভবিষ্যতে সুযোগ মতো আরও বেশি বলবে”।
যদিও বিশেষ মানবিক কারণে তিন দফায় ২০১০, ২০১৪ ও ২০১৫ সালে কোনো ধরণের ফি ছাড়াই আশুগঞ্জ নৌ বন্দর ও আশুগঞ্জ-আখাউড়া প্রায় ৪৫ কিলোমিটার সড়ক ব্যবহার করে বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ভারি মালামাল এবং খাদ্যশস্য ট্রানজিট করেছিল ভারত, যার তীব্র সমালোচনা করেছিলেন বিএনপি নেতারা।
শেষ পর্যন্ত সব বিরোধিতা উপেক্ষা করেই মাশুলের বিনিময়ে ভারত বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিক ট্রানজিট সুবিধা শুরু হয় ২০১৬ সালের ১৬ই জুন এবং এটিই ছিলো নৌ প্রটোকল চুক্তি অনুযায়ী প্রথমবারের মতো ট্রানজিটের পণ্য ভারতে যাওয়া।
কিন্তু এরপর থেকে খুব বেশি পণ্য পরিবহনে আগ্রহ দেখা যায়নি ভারতের দিক থেকেই। একই সাথে স্তিমিত হয়ে আসে ট্রানজিট বিষয়ক আলোচনা, উত্তাপ, বিতর্ক কিংবা বক্তব্য-পাল্টা বক্তব্য। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন ট্রানজিট নিয়ে সব পক্ষের আগ্রহেই ভাটা পড়েছে কিনা। যদিও এর সাথে একমত নন ট্যারিফ কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান ও ট্রানজিট-সংক্রান্ত তখনকার কোর কমিটির প্রধান মজিবুর রহমান।
তিনি বলেন, “আগ্রহ হারাবে কেনো। আগে যেটা ছিলো কোনো অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াই বিরোধিতার জন্য বিরোধিতা করা হতো। এখন মানুষ বাস্তবতা উপলব্ধি করছে। ট্রানজিটের কাজগুলো আস্তে আস্তে এগুচ্ছে। খু্ব দ্রুত গতিতে এগুচ্ছেনা। তবে এগুচ্ছে। ভারত ও বাংলাদেশে এখন সবাই মনে করে ট্রানজিটের অর্থনৈতিক বেনিফিট আছে। সে কারণেই এখন আর তত হৈ চৈ শোনা যায়না”।
তবে সেই ইকোনমিক বেনিফিট বা অর্থনৈতিক লাভ কতটা হচ্ছে তা নিয়েও তেমন একটা আলোচনা শোনা যায়না। কর্মকর্তারা বলছেন ট্রানজিটের আনুষ্ঠানিক শুরুর পরের তিন বছরে মাত্র ১৯ হাজার মেট্রিক টন নৌ পথে বাংলাদেশ হয়ে পরিবহন হওয়ার তথ্য রয়েছে। যদিও চুক্তি অনুযায়ী ভারতের সাতটি বন্দর থেকে পণ্য আসার কথা ছিলো। পণ্য পরিবহনের জন্য বাংলাদেশ ও ভারত প্রান্তে অবকাঠামো উন্নয়নের কথাও বলা হয়েছিলো।
মিস্টার রহমান বলছেন পুরো বিষয়টি এখন স্বাভাবিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম হিসেবেই বিবেচনা হচ্ছে সব মহলে। তাছাড়া এর আওতায় যোগাযোগ আরও সহজ হয়ে আসছে যাতে উপকৃত হচ্ছে সাধারণ মানুষ।
“মোটরযানের ওপর একটা চুক্তি চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে থমকে আছে। নৌ ট্রানজিটে প্রটোকল আছে ও সেটা আরও শক্তিশালী করার সম্ভাবনা প্রধানমন্ত্রীর এই সফরেও আছে। রেলওয়ে ট্রানজিটের জন্য কথাবার্তা চলছে তবে পুরো অগ্রগতি হয়নি। সেটি হলে পদ্মা বা যমুনায় রেলসেতু হলে রেল ট্রানজিটও বাস্তবতায় রূপ নেবে বলে আমি বিশ্বাস করি”।
অর্থাৎ নৌ ট্রানজিট শুরুর তিন বছর পরে এসেও ট্রানজিট আসলে খুব একটা গতি লাভ করেনি। আবার একই সময়ে রাজনৈতিক অঙ্গন কিংবা সাধারণ মানুষের আলোচনা থেকেও ট্রানজিট ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। যদিও বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা সংস্থা পরিচালিত ‘ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ এ্যান্ড দ্য নর্থ ইস্ট : ট্রানজিট এ্যান্ড ট্রান্সশিপমেন্ট-স্ট্র্যাটেজিক কনসিডারেশন’ শীর্ষক একটি গবেষণায় ট্রানজিট থেকে বাংলাদেশের প্রত্যক্ষ লাভ সীমিত হবে বলে দেখানো হয়েছিলো। বিআইডিএসের তখনকার গবেষণা পরিচালক কেএএস মুরশিদ এই গবেষণাটি করেছেন।
“এক সময় বলা হতো ট্রানজিট হলে বাংলাদেশের বিপুল লাভ হবে। এখন বোঝা গেছে সেটার সম্ভাবনা কম। মূলত এটা ভারতের জন্য ভালো। প্রতিদানে সরাসরি আমাদের অর্থ পাওয়ার সুযোগ কম। এজন্যই সম্ভবত এটা নিয়ে আর আলোচনা হয়নি। চুক্তি হয়েছে বটে কিন্তু সেই অর্থ জিনিসপত্র ও মানুষের আদানপ্রদান কম। তাই এর প্রভাব চোখে পড়ার মতো নয়। এটা আসলে শুরু হয়নি”।
মিস্টার মুরশিদ মনে করেন এসব কারণে ট্রানজিট নিয়ে সবক্ষেত্রেই তাপ উত্তাপ কমে গেছে। যদিও এ মতামতের সাথে একমত নন অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ।
তিনি বলেন অনেক কিছুতে অগ্রগতি হয়েছে। মোটর যান ট্রানজিট নিয়ে চূড়ান্ত আলোচনা চলছে। তাই যেহেতু অগ্রগতি হয়ে গেছে সে কারণে ট্রানজিটের পক্ষ বিপক্ষের বিতর্কের অবসান হয়ে গেছে।
“অনেক কিছুতে অগ্রগতি হয়েছে। ট্রানজিটের নৌ পথ-সেখানে কিছু পরিবর্তন এসেছে। যদিও কিছু সফল কিছু ব্যর্থ। হবে কি হবেনা-সেই বিতর্কে আমরা আর নেই। আমি পছন্দ করি বা না করি অগ্রগতি হচ্ছে। প্রভাব ভবিষ্যতে কি হবে সেটা দেখতে হবে। আবার কিছু চলমান আছে যেমন মোটর যান। এটা নিয়ে কাজ হচ্ছে। তাই ট্রানজিট দিবো কি দিবোনা তা থেকে অনেকখানি আমরা এগিয়েছি”।
নাজনীন আহমেদের মতে এসব কারণেই মূলত ট্রানজিট নিয়ে এখন আর তেমন বিতর্ক শোনা যায়না।
তবে সরকারের নৌ পরিবহন প্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরী বলছেন ট্রানজিট বিরোধীতাকারীরা ভারত বিরোধিতার যে ভয় দেখাতে চেয়েছিলো সেটি ছিলো তাদের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি।
তিনি বলেন “ট্রানজিট না। কানেকটিভিটি আমরা আরও শক্তিশালী করেছি, যা দিয়ে বাংলাদেশ লাভবান হচ্ছে। যারা এতদিন রাজনীতি করার চেষ্টা করেছে তারা ভারত বিরোধী সেন্টিমেন্ট তৈরি করে ধোঁকাবাজি করেছে। এটা বাংলাদেশের মানুষ বুঝে ফেলেছে। সে কারণে তারাও এখন চুপ হয়েছে কারণ এ ঔষধ আর কাজে লাগছেনা”।
মিস্টার চৌধুরী বলছেন প্রধানমন্ত্রীর এবারের সফরেও চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দর ব্যবহার করে বাকী সড়ক পথ ব্যবহারের বিষয়ে এসওপি স্বাক্ষর হয়েছে যা থেকে দেশের মানুষ লাভবান হবে ও আঞ্চলিক সম্পর্ক জোরদার হবে। সৌজন্যে: বিবিসি বাংলা অনলাইন