বান্দরবান কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠ পাকা করা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনা-সমালোচনার ঝড় উঠেছে। জেলা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত মাঠটি পাকা করলে এলাকার পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে, শিশুদের খেলাধুলার কোনো জয়গা থাকবেনা- এমন বলছেন অনেকে। কেউ আবার বলছেন, ঈদের নামাজ আদায়ের সুবিধার্থে মাঠটি পাকা হওয়া দরকার।
১৫ মে বান্দরবান সদর থানা ও পুলিশ সুপার কার্যালয় সংলগ্ন ঈদগাহ মাঠে গিয়ে সেখানে রড বিছিয়ে পাকা করার বন্দোবস্ত করতে দেখা গেছে শ্রমিকদের।
সেদিনই মাঠটি পাকা করার ব্যাপারে বান্দরবানের এক গণমাধ্যমকর্মী সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে স্থানীয় নাগরিকদের মতামত জানতে চান। কয়েক ঘন্টার মধ্যে প্রায় একশ’রও বেশি নাগরিক সেখানে নিজেদের মন্তব্য প্রকাশ করেন। যার বেশিরভাগই মাঠটি পাকা করার বিপক্ষে। তাঁরা সবুজায়নের পক্ষে নিজেদের মতামত তুলে ধরেন।
বান্দরবান সরকারি কলেজের প্রভাষক মেহেদী হাসান এবং এলাকার বাসিন্দা মোহাম্মদ নাঈম, ওমর ফারুক সাদ্দাম, সন্তোষ দাশ, নাছিরুল আলম, রুবেল চৌধুরীসহ অনেকে মাঠটিতে প্রয়োজনীয় পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রেখে ঘাস লাগিয়ে সবুজ রাখার পক্ষে মত দেন।
আইনজীবি আবু জাফর লেখেন, ‘উনাদের বাচ্চাকাচ্চারা এই দ্যাশে থাকবে না। থাকলেও বান্দরবানে থাকবেনা। মাঠ দিয়া উনাদের কী লাভ? বাঙাল মুসলমান লাথি গুঁতার উপ্রে থাকা জাত! মন্দির-প্যাগোডা পাকা হৈতেসে দেইখা এরা ঈদগাহ ময়দানও পাকা দেখতে চায়।’
এটিএন বাংলার বান্দরবান প্রতিনিধি মিনারুল হক লেখেন, ‘এখানে ঠিকাদারই প্রকল্প গ্রহণ করেন এবং নিজেই বাস্তবায়ন করেন লাভের আশায়।’
এনটিভি’র বান্দরবান প্রতিনিধি আলাউদ্দিন শাহরিয়ার লেখেন, ‘ঈদগাহ মাঠ পাকা হতে হবে কেন? দেশের সবচেয়ে বড় ঈদের জামাত হয় শোলাকিয়ায়। সেটি কি পাকা? সবুজ ঘাস, সবুজ মাঠ, অন্যরকম আকর্ষনীয়।
দৈনিক প্রথম আলোর বান্দরবান প্রতিনিধি বুদ্ধজ্যোতি চাকমা লেখেন, সবই আর্থ-রাজনীতি। অর্থাৎ বিল ভাউচার কেন্দ্রিক রাজনীতি। দুই বছর পরে নিশ্চয় ঘাস লাগানোর প্রকল্পের প্রয়োজন হবে। তখন কংক্রীটের গাঁথুনি সরাতেও একটি প্রকল্প হবে। সবই উন্নয়ন ও উন্নয়নের রাজনীতি। আয়নার সামনে দাঁড়ানোর ঝুঁকি নেই।’
রাঙামাটির সাংবাদিক চৌধুরী হারুনুর রশিদ লেখেন, ‘রাঙ্গামাটি জজকোর্টের সামনে ও রিজার্ভ শহীদ আব্দুর শুক্কুর স্টেডিয়ামে ছেলেরা খেলে। সবচেয়ে ২টি বড় ঈদ জামায়াত অনুষ্ঠিত হয়। সবুজ ঘাস আছে কিন্তু মিনার পর্যন্ত পাকা করে নাই।’
মামুনুর রশিদ পারভেজ নামের একজন লেখেন, ‘পাকা করতে গেলে টেন্ডার হয়। বাজেটের সামান্য একটা অংশ খরচ করে বাকিটা পকেটে ঢুকানো যায়। সবুজের মায়া কিংবা ধর্মীয় ভাব কোনটাই দরকার নেই। পৃথিবীর প্রতি ইঞ্চি জমি নামাজের জন্য পবিত্র।’
মোহাম্মদ আবু তাহের নামের একজন লেখেন, ‘বান্দরবান শহরটির আয়তন ছোট তাই অনেকের মনে হচ্ছে বাচ্চাদের খেলার জায়গা নেই সেটা সত্য। আবার এটাও সত্য যে ছোট জেলা হিসাবে স্টেডিয়ামটা বড়। আবার দেখা যায় সাঙ্গু নদীর চরেও খেলাধুলার ব্যবস্থা করা যায়। ঈদের নামাজে প্রতি বছর ডেকোরেশন করা হয় কিন্তু যদি বেশি বৃষ্টি হয় তাহলে মাঠে কাদা হলে নামাজ পড়া অসম্ভব। তাই পাকা করা খুবই দরকার মনে করি। কারণ খেলার মাঠের জন্য সবাই চেষ্টা করেন অন্য জায়গায় করা যায় কিনা।’ এভাবে বেশিরভাগ মানুষ মাঠটি পাকা করার বিপক্ষে তাদের মতামত প্রকাশ করেন।
বিষয়টি জানতে যোগাযোগ করা হয়েছিলো বান্দরবান কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত উদযাপন কমিটির আহবায়ক সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান আবদুল কুদ্দুছ এর সাথে। তিনি জানান, ‘মাঠ পাকা করার বিষয়টি আমি জানিনা। কয়েকদিন আগে চলার পথে ওখানে কাজ করতে দেখেছি। সেখানে কি বিল্ডিং হবে নাকি অন্য কী হবে আমি জানতে পারিনি।’
বান্দরবান কেন্দ্রীয় ঈদ জামাত উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব ও পৌর মেয়র মোঃ ইসলাম বেবী জানান, ‘ঈদগাহ মাঠ আগে থেকেই পাকা ছিলো। কিছু কিছু অংশ ভেঙ্গে গেছে। বর্ষাকালে ঈদ হলে মাঠে বৃষ্টির পানি জমে যায়। আমাদের আগামী প্রজন্ম যেন ঠিকমতো ঈদের নামাজ আদায় করতে পারে, তাই জেলা প্রশাসকসহ আমরা মাঠটি পাকা করার প্রকল্প চেয়েছি।’
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ দাউদুল ইসলাম জানান, ‘আমার আমলে মাঠ পাকা করার কোনো সুপারিশ করা হয়নি। পাকা করা ঠিক হচ্ছে নাকি ভুল হচ্ছে সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চাইনা।’
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিষয়ক মন্ত্রী বীর বাহাদুর উশৈসিং জানান, ‘ঈদের সময় বৃষ্টি হলে মুসল্লীদের নামাজ আদায়ে অসুবিধা হতো। সেজন্যে কীভাবে মাঠে ঠিকমতো ঈদের জামাত আদায় করা যায়, সে ব্যাপারে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মহলের সাথে আলাপ হয়েছে। প্রথমে আমি বলেছিলাম মাঠের চারপাশে ওয়াকওয়ে (পায়ে হাঁটার ব্যবস্থা) এবং তার নীচে পানি নিষ্কাশনের ড্রেন নির্মাণ করতে। পরে কেউ কেউ হয়তো পুরো মাঠ পাকা করার সুপারিশ করেছেন। সে অনুযায়ী প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এখন এটি পাকা করার পক্ষেও কিছু মানুষ আছে, বিপক্ষেও কিছু মানুষ আছে। এটি নিয়ে বিতর্কের কিছু নেই।’
মাঠটির পাকাকরণ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। প্রতিষ্ঠানটির বান্দরবান ইউনিটের নির্বাহী প্রকৌশলী ইয়াছির আরাফাত জার্নান, মাঠের চারপাশে ওয়াকওয়ে এবং ড্রেনেজ সিষ্টেমের কাজ বাস্তবায়ন হচ্ছে ১ কোটি টাকায়। এরপর মাঠ পাকা করা এবং মেহরাব (ইমামের দাঁড়ানোর স্থান) তৈরির জন্যে আরো ১ কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। যা দুই অর্থবছরে বাস্তবায়ন করা হবে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঠিকাদার ইউ.টি.মং-এর নামে কার্যাদেশ দেয়া এই প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে শাইনপুকুর কন্সট্রাকশন নামের একটি প্রতিষ্ঠান।
উল্লেখ্য, ২০০৮ সালের নভেম্বর মাসে বান্দরবান কেন্দ্রীয় ঈদগাহ মাঠটিতে ইট বিছিয়ে তার ওপর সিমেন্টের আস্তরণ দেওয়া হয়। পরে সেই সিমেন্টের আস্তরণ নষ্ট হয়ে গেলে আরসিসি ঢালাই দিয়ে মাঠ পাকা করা এবং চারপাশে ওয়াকওয়ে নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড।