দেখে মনে হতে পারে, পাহাড়ের জুম ক্ষেতে স্বাভাবিক কোনো ধান কাটার দৃশ্য। তবে, এরা কোনো সাধারণ জুমচাষী নয়। একদল তরুণ শিক্ষার্থী দল বেঁধে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ করে দিচ্ছেন কয়েকটি অস্বচ্ছল জুমিয়া পরিবারকে।
সম্প্রতি এমন ঘটনা চোখে পড়লো বান্দরবান সদরের জামছড়ি এলাকায়। জুমক্ষেতে এভাবে শ্রম দেবার কারণ জানালেন সেখানে কাজ করতে আসা শিক্ষার্থীরা।
প্রতি বছর জুমের ধান কাটার মৌসুমে নিজেদের হোস্টেলে থাকা শিক্ষার্থীদের এভাবেই স্বেচ্ছাশ্রমে সম্পৃক্ত করে হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন নামের একটি উন্নয়ন সংস্থা।
ধীরে ধীরে শহরমুখী হচ্ছে পাহাড়ের নতুন প্রজন্ম। পূর্বপুরুষের কৃষিভিত্তিক জীবনযাত্রার সাথেও বাড়ছে দূরত্ব। কৃষকের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে স্বেচ্ছাশ্রম দানের এ রকম উদ্যোগ সেই দূরত্ব কিছুটা হলেও কমাতে পারে। এমনটাই আশা সংশ্লিষ্টদের।
জুম চাষ সম্পর্কে আরো কিছু প্রাসঙ্গিক তথ্য:
জুম চাষ: বাংলাদেশের পাহাড়ি এলাকার কৃষি প্রথা
জুম চাষ বাংলাদেশের পার্বত্য অঞ্চলের অধিবাসীদের মধ্যে প্রচলিত একটি ঐতিহ্যবাহী কৃষি প্রক্রিয়া। এটি বিশেষভাবে খাসিয়া, মারমা, চাকমা, ম্রো, তঞ্চঙ্গ্যা, খেয়াং, খুমী, বম, লুসাই, ত্রিপুরাসহ পার্বত্য জনগোষ্ঠীর প্রাচীনকাল থেকে পালন করা কৃষি ব্যবস্থা। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় পাহাড়ের ঢালু জমিতে এই চাষের প্রচলন রয়েছে, যা মূলত পাহাড়ের ভূমিকে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে ব্যবহার করে ফসল উৎপাদন করার কৌশল।
জুম চাষের প্রক্রিয়া
জুম চাষের প্রক্রিয়া বেশ আলাদা ও আকর্ষণীয়। এর প্রধান বৈশিষ্ট্য হলো ভূমির ঘূর্ণন বা পরিক্রমণ পদ্ধতি। প্রথমে পাহাড়ের একটি ঢালু জায়গা নির্বাচন করা হয়। এরপর স্থানটি পরিষ্কার করার জন্য জঙ্গল ও ছোট গাছপালা কেটে ফেলা হয়। চাষের উপযোগী করার জন্য কেটে ফেলা ঝোপজঙ্গল আগুন ধরিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়।
মাটির প্রস্তুতির পর চাষীরা বিভিন্ন প্রজাতির বীজ একসঙ্গে বপন করেন। এই মিশ্রিত বীজের মধ্যে থাকে ধান, ভুট্টা, আলু, মরিচ, মার্ফা, চিনার, তিল, তুলা শাকসবজি ইত্যাদি। তারা একফসলি জমিতে বিভিন্ন প্রজাতির শস্য উৎপাদন করেন, যা এই চাষের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সাধারণত একবার ফসল তোলার পর আবার সেই জমিতে চাষ করা হয় না। বরং একে বিশ্রাম দিয়ে অন্য কোনো নতুন জমিতে চাষ শুরু করা হয়। এই ফাঁকে ফেলে রাখা জমি স্বাভাবিকভাবে পুনরায় উর্বর হয়। জুমের উৎপাদন বিক্রয় ও বিপণনভিত্তিক উৎপাদন নয়। অর্থাৎ বাজারে বিক্রি করার উদ্দেশ্যে জুমে ফসল ফলানো হয় না। নিজেদের সারা বছরের চাহিদা পূরণের জন্যই ফসল ফলানো হয়।
জুম চাষের সুবিধা ও অসুবিধা
সুবিধা:
১. স্বাধীন কৃষি প্রথা: জুম চাষ পার্বত্য এলাকার জনগণের জন্য একটি স্বাধীন কৃষি ব্যবস্থা, যা তাদের সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের অংশ।
২. জমির বিশ্রাম: এই চাষ প্রক্রিয়ায় একফসলি জমিকে পুনরায় উর্বর হতে সময় দেওয়া হয়, ফলে দীর্ঘমেয়াদে মাটির গুণমান বজায় থাকে।
৩. মিশ্র ফসল চাষ: একই জমিতে একাধিক ফসল চাষ করা হয়, ফলে মাটির বিভিন্ন স্তরের পুষ্টি উপাদান ব্যবহার হয় এবং বিভিন্ন ধরনের খাদ্য উৎপাদিত হয়।
৪. প্রাকৃতিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণ: পার্বত্য অঞ্চলের পরিবেশে জুম চাষ একটি ভারসাম্যপূর্ণ পদ্ধতি। এটি জৈবিক বৈচিত্র্য সংরক্ষণের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
অসুবিধা:
১. বন উজাড়: জুম চাষের জন্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে বন উজাড় করা হয়, যা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। জমি পরিষ্কার করার জন্য আগুন ব্যবহার করার ফলেও কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাটির পুষ্টি উপাদান নষ্ট হয়ে যেতে পারে।
২. ফসল উৎপাদনের সীমাবদ্ধতা: জুম চাষে ফসল উৎপাদন অপেক্ষাকৃত কম হয় এবং তাতে আধুনিক কৃষি পদ্ধতির তুলনায় অনেক বেশি জমি প্রয়োজন।
৩. ভূমির ক্ষয়: পাহাড়ের ঢালু জমিতে চাষ করায় ভূমিক্ষয় ও মাটির স্থায়ীত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, যা ভবিষ্যতে কৃষির জন্য সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।
জুম চাষের আধুনিকীকরণ ও বিকল্প পদ্ধতি
বর্তমানে জুম চাষের কিছু সমস্যা সমাধানে সরকার ও এনজিও সংস্থাগুলো বিভিন্ন বিকল্প ব্যবস্থা গ্রহণ করছে। পার্বত্য অঞ্চলে টেকসই কৃষি পদ্ধতি ও পরিবেশ সংরক্ষণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি, জৈব সার ব্যবহার এবং সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
জুম চাষ পার্বত্য অঞ্চলের মানুষের জীবিকা নির্বাহ ও সাংস্কৃতিক পরিচয়ের সাথে গভীরভাবে জড়িত। জুম চাষের সাথে স্থানীয় অধিবাসীদের বিভিন্ন ধর্মীয় ও সামাজিক রীতিনীতি চর্চিত হয়ে থাকে। তবে কালক্রমে জুম চাষের উপযোগী জমি কমে যাওয়া এবং ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা অনুযায়ী ফলন না পাওয়ায় এটি লাভজনক হচ্ছে না। তবে, এর টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার জন্য আধুনিক প্রযুক্তির সাথে ঐতিহ্যবাহী পদ্ধতির সংমিশ্রণ করা জরুরি।