সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সুলতানা কামাল বলেছেন, বাংলাদেশ ক্রমেই যেন সংকুচিত হয়ে আসছে। বিভিন্ন ধর্মের বিভিন্ন বিশ্বাসের মানুষ মনে করছেন, বাংলাদেশ তাঁদের সমান অধিকার দিচ্ছে না, তাঁদের মর্যাদার হানি হচ্ছে। শুধু তা-ই নয়, নির্মম অত্যাচারেরও শিকার হচ্ছেন।
বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদের দ্বিতীয় ত্রি-বার্ষিক সম্মেলনে এ কথা বলেন সুলতানা কামাল। জাতীয় প্রেসক্লাবের মিলনায়তনে এই সম্মেলনের আয়োজন হয় আজ শুক্রবার সকালে।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন, দেশে জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রতিটি নাগরিকের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিটি নাগরিক সমান অধিকারের ভাগীদার। এটা সংবিধানে বলা আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, একটি বিশেষ গোষ্ঠীর দুর্বৃত্তায়নের ফলে কখনো কখনো রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় কিংবা আজকে রাজনীতির যে বিশেষ চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য দেখা যাচ্ছে, সেটার কারণে বাংলাদেশ যেন ক্রমেই সংকুচিত হয়ে আসছে।
সম্মেলনে বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদের দ্বিতীয় ত্রি-বার্ষিক প্রতিবেদন পাঠ করা হয়। প্রতিবেদনে গত তিন বছরে সংখ্যালঘু (ধর্মীয় ও জাতিগত) জনগোষ্ঠীর ওপর সংঘটিত মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনার চিত্র তুলে ধরা হয়। প্রতিবেদনটি বলছে, ২০১৭ সালে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ৮২ জন খুন হয়। প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে ২২৮টি, শ্মশান ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের সম্পত্তি দখলের ঘটনা ঘটে ২৭টি, গণধর্ষণ ঘটে ১৫টি ও নিখোঁজ হয় ২১ জন।
সংখ্যালঘু নির্যাতনের এই পরিসংখ্যান বার্ষিক প্রতিবেদন আকারে প্রতিবছর বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদন তৈরিতে বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদ সহযোগিতা করে।
সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রসঙ্গে সুলতানা কামাল বলেন, গত তিন বছরে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সংখ্যালঘুদের ওপর নানা ধরনের অত্যাচার করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ড থেকে শুরু করে ধর্ষণ, তাঁদের বাড়িঘরে হামলা, অগ্নিসংযোগ, মন্দির-গির্জা-উপাসনালয় ঘিরে ফেলা, হুমকি দেওয়া, দেশ ছাড়তে বাধ্য করা, ধর্মান্তরিত করা, হয়রানিমূলক আচরণ করাসহ গরুর মাংস খাওয়ানোর মতো হীন আচরণ পর্যন্ত তাঁদের সঙ্গে করা হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে তিন থেকে পাঁচটি এমন ঘটনা ঘটেছে। সব মিলিয়ে, গত বছর ১ হাজার ৪টি ঘটনা ঘটে। ঘটনাগুলোর নৃশংসতা অত্যন্ত বর্বরোচিত।
সুলতানা কামাল আরও বলেন, ‘প্রতিটি ঘটনায় দেখা যায়, জনগোষ্ঠীকে হয়রানি করার জন্য মিথ্যার আশ্রয় পর্যন্ত নেওয়া হয়েছে। দুঃখের সঙ্গে বলতে হয়, ঘটনাগুলোর কোনো রকমের কার্যকর বিচার এখনো হয়নি। যদি বিচার হতো, কোনো দীর্ঘসূত্রতা না থাকত, যদি সত্যিকার অর্থে অপরাধীদের চিহ্নিত করে যথাসময়ে শাস্তির আওতায় আনা হতো, তাহলে এই ঘটনাগুলো এত ব্যাপক হারে ছড়িয়ে যেতে পারত না। রাষ্ট্রের যে ভূমিকা ছিল, তা সেভাবে পালন করেনি।’
নারী অধিকার সম্পর্কে মানবাধিকারকর্মী সুলতানা কামাল বলেন, ‘নারীরা অধিকারের আদায়ে আন্দোলন করলে তা রুখে দেওয়া খুবই কঠিন হয়ে যায়। নারীরা সচেতন হলে সেই সংগ্রাম, আন্দোলন অনেক বেশি বেগবান হয়। তবে যে রাষ্ট্র বা সমাজ পুরুষতান্ত্রিক, তাঁরা সব সময় চেষ্টা করে নারীরা যেন জেগে না ওঠে। নারীর জাগরণ ও উত্থানকে পুরুষতান্ত্রিক সমাজ সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে মনে করে। আর সেটা যখন তাঁরা ঠেকাতে পারে না, তখন নারী নির্যাতনও তাঁরা অনেক বেশি বাড়িয়ে দেয়। সেই অবস্থাটা আমরা এখন দেখতে পাচ্ছি।’ তিনি নারীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহ্বান জানান।
সম্মেলন উদ্বোধন করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত। সভাপতির বক্তব্য দেন বাংলাদেশ মহিলা ঐক্য পরিষদের সভাপতি জয়ন্তী রায়।