খ্রিস্টান ধর্মের রোমান ক্যাথলিক শাখার প্রধান ধর্মগুরু ও সার্বভৌম ভ্যাটিকান সিটির প্রধান পোপ ফ্রান্সিসের বাংলাদেশ সফর শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার দুপুরে বাংলাদেশ বিমানের বিশেষ ফ্লাইটযোগে ঢাকা এসে পৌঁছালে বিমান বন্দরে তাকে লাল গালিচা সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সন্ধ্যায় বঙ্গভবনে বিশিষ্ট নাগরিকদের এক সমাবেশে পোপ গুরুত্বপূর্ণ বক্তব্য রাখেন। এখানে তিনি সংকটজনক সময়ে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে বিশ্ববাসীর প্রতি আহবান জানান। বিশ্ববাসীকে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হবে। কেবল রাজনৈতিক বিষয়ে সমাধান নয়, মানবিক সহায়তাও দিতে হবে।
বার্তা সংস্থা বিডি নিউজ জানায়, বঙ্গভবনের অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে ‘রোহিঙ্গা’ শব্দটি এড়িয়ে যান পোপ। মিয়ানমার সফরেও রোহিঙ্গা নামটি উচ্চারণ না করায় তার সমালোচনা হচ্ছে বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠন থেকে।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে বঙ্গভবনে একান্ত বৈঠকের পর দরবার হলে মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও কূটনীতিকদের উপস্থিতিতে তিনি বক্তব্য দেন। স্পেনিশ ভাষায় তিনি বক্তব্য দেওয়ার সময় তা পাশে থাকা পর্দায় ইংরেজিতে দেখানো হচ্ছিল।
রোহিঙ্গা সঙ্কটের দিকে ইঙ্গিত করে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, গত কয়েক মাসে রাখাইন থেকে আসা বিপুল সংখ্যক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে এবং তাদের মৌলিক প্রয়োজন পূরণ করার মধ্যে দিয়ে বাংলাদেশ উদার মন এবং অসাধারণ সংহতির পরিচয় দিয়েছে। এটা ছোট কোনো বিষয় নয় বরং পুরো বিশ্বের সামনেই এটি ঘটেছে। পুরো পরিস্থিতি, মানুষের অবর্ণনীয় কষ্ট এবং শরণার্থী শিবিরগুলোতে থাকা আমাদের ভাই-বোন, যাদের বেশিরভাগই নারী ও শিশু, তাদের ঝুঁকির গুরুত্ব বুঝতে আমরা কেউই ব্যর্থ হইনি।
অনুষ্ঠানে বক্তব্যে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ মিয়ানমারে নিপীড়িত মুসলিম রোহিঙ্গাদের উপর সহিংসতার বিরুদ্ধে পোপের অবস্থানকে ‘প্রশংসনীয়’ উল্লেখ করে বলেন, ক্যাথলিক ধর্মগুরুর এই অবস্থান সঙ্কট সমাধানে আশা দেখাচ্ছে।
তিনি পোপ ফ্রান্সিসের উদ্দেশে বলেন, রোহিঙ্গাদের প্রতি মমত্ববোধ, তাদের সাহায্য ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় আপনার ঐকান্তিক আহ্বান এ বিষয়ে দ্রুত ও আন্তরিকভাবে কাজ করতে বিশ্ব সম্প্রদায়কে নৈতিক বাধ্যতা দেয়। এই সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এগিয়ে আসাটা অপরিহার্য বলে মন্তব্য করেন পোপ।
তিনি বলেন, কঠিন এই সঙ্কট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত্। শুধু রাজনৈতিক বিষয়ের সমাধানই নয়, বাংলাদেশে দ্রুত মানবিক সহায়তাও দিতে হবে।
রাষ্ট্রপতি পোপের সামনে সার্বিক অবস্থা তুলে ধরে বলেন, আমাদের সরকার প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়েছে, যাদেরকে নিজেদের আবাসভূমি মিয়ানমারের রাখাইন থেকে জোরপূর্ব বাস্তুচ্যুত করা হয়েছে। নারী-শিশুসহ হাজারো মানুষকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়েছে। নিজেদের বাড়ি ভষ্মীভূত হতে তারা নিজ চোখে দেখেছে। মিয়ানমার সেনাবাহিনীর নির্মম নৃশংসতার কারণে তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে হয়েছে। আমাদের জনগণ তাদের খোলামনে স্বাগত জানিয়েছে। খাদ্য-আশ্রয় ও অন্যান্য প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিচ্ছে।
আবদুল হামিদ বলেন, আপনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, মানুষ যখন তাদের বিশ্বাসের চর্চা ভয়মুক্ত পরিবেশে চর্চা করতে পারে। আমাদের দেশে আমরা ধর্মীয় স্বাধীনতাকে লালন করি।
পোপ ফ্রান্সিসও বলেন, প্রাথমিকভাবে যদিও আমার সফরের উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের উদ্দেশে বক্তব্য দেওয়া, তারপরও আগামীকাল রমনায় বিভিন্ন ধর্মীয় নেতাদের সঙ্গে আমার সাক্ষাত্ গুরুত্বপূর্ণ।
সেখানে আমরা সবাই একসাথে শান্তির জন্য প্রার্থনা করব এবং শান্তির জন্য কাজ করতে আমাদের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করব।
বর্তমান বিশ্বে কোনো দেশ, জাতি কিংবা রাষ্ট্র একা এগিয়ে যেতে পারে না উল্লেখ করে পোপ বলেন, মানবজাতির সদস্য হিসেবে আমাদের একে অন্যকে প্রয়োজন এবং পরস্পরের ওপর নির্ভর করতে হয়।
ভাষণের শুরুতেই সফরের আমন্ত্রণ জানানোয় রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানান পোপ ফ্রান্সিস। দুই পূর্বসূরি পোপ ষষ্ঠ পল, পোপ দ্বিতীয় জন পলের বাংলাদেশ সফরের কথাও স্মরণ করেন তিনি।
বাংলাদেশকে ‘নবীন’ রাষ্ট্র উল্লেখ করে পোপ ফ্রান্সিস বলেন, তারপরও পোপদের হূদয়ে এই দেশের জন্য সবসময়ই বিশেষ স্থান রয়েছে।
বাংলাদেশে আসার পথে এই দেশকে ‘সোনার বাংলা’ হিসেবে তার কাছে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়েছিল উল্লেখ করেন তিনি। এদেশে জালের মতো ছড়িয়ে থাকা ছোট-বড় নদী আর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য সম্পর্কেও জেনেছেন তিনি।
আমি মনে করি, এখানকার প্রাকৃতিক সৌন্দর্যই আপনাদের বিশেষ পরিচয়ের ধারক। বাংলাদেশ এমন একটি দেশ, যেখানে বিভিন্ন ভাষাভাষী ও সংস্কৃতির জাতি-গোষ্ঠীর মধ্যে ঐক্য রয়েছে।
বাংলাদেশের জাতির জনকের কথা উল্লেখ করে পোপ বলেন, ‘প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়টি বুঝতে পেরেছিলেন এবং এই আদর্শ সংবিধানে যুক্ত করার কথা বলেছিলেন। তিনি আধুনিক, বহুত্ববাদী এবং অংশগ্রহণমূলক একটি সমাজের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে প্রতিটি মানুষ এবং জাতি মুক্ত, শান্তি ও নিরাপত্তার মধ্যে বসবাস করতে পারবে, যেখানে পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ এবং সমান অধিকার থাকবে।’
বাংলাদেশে বিভিন্ন ধর্মের মানুষের সহাবস্থানের প্রশংসা করেন পোপ। তবে বিভক্তি তৈরি করতে কখনো কখনো ধর্মকে ব্যবহার করা হয় বলেও মন্তব্য করেন তিনি। গত বছর গুলশানে জঙ্গি হামলার কথাও তিনি স্মরণ করেন।
বাংলাদেশে ক্যাথলিকরা সংখ্যায় কম হলেও স্কুল, ক্লিনিক এবং স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার মধ্যে দিয়ে এই দেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ রেখে চলেছে মন্তব্য করে ভবিষ্যতেও তা অব্যাহত থাকবে বলে আশা প্রকাশ করেন পোপ।
বঙ্গভবনে পৌঁছার পর প্রথমে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের সঙ্গে একান্ত বৈঠক করেন পোপ ফ্রান্সিস; পরে তিনি দরবার হলে তিনি মন্ত্রিপরিষদের সদস্য, বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ ও কূটনীতিকদের সামনে ভাষণ নিয়ে আসেন। বঙ্গভবনের পরিদর্শন বইয়েও স্বাক্ষর করেন তিনি।
অনুষ্ঠানে মন্ত্রীদের মধ্যে আবুল মাল আবদুল মুহিত, সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, আনিসুল হক, হাসানুল হক ইনু, এ এইচ মাহমুদ আলী, আসাদুজ্জামান নূর, প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা গওহর রিজভী, মসিউর রহমান ছিলেন। ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বী মিয়াও ছিলেন অনুষ্ঠানে।
বিশিষ্ট ব্যক্তিদের মধ্যে ছিলেন সম্পাদক গোলাম সারওয়ার, সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব হাসান ইমাম, সারাহ বেগম কবরী, রামেন্দু মজুমদার প্রমুখ।
তিন বাহিনী প্রধান, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সচিবরা উপস্থিত ছিলেন এই অনুষ্ঠানে। ছিলেন যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাটসহ বিভিন্ন দেশের কূটনীতিকরা।
বাংলাদেশের কার্ডিনাল প্যাট্রিক রোজারিও, ভ্যাটিকানের দূত জর্জ কোচেরি তাদের প্রধান ধর্মগুরুর সঙ্গে ছিলেন।
কৃতজ্ঞতা- দৈনিক ইত্তেফাক