‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার প্রতিবেদন ২০১৭’ প্রকাশ করেছে কাপেং ফাউন্ডেশন নামের একটি সংগঠন। ২৯ মার্চ ২০১৮ ঢাকার ডেইলি স্টার ভবনে ২০১৭ সালের বাংলাদেশের আদিবাসীদের ওপর মানবাধিকার পরিস্থিতির প্রতিবেদন প্রকাশ ও আলোচনা সভায় এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।
এ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত প্রতিবেদন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন ও আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন কাপেং ফাউন্ডেশন চেয়ারপার্সন এবং জাতীয় আদিবাসী পরিষদ-এর সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্ট মানবাধিকার কর্মী ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এ্যাডভোকেট সুলতানা কামাল।
সম্মানিত অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলন, আদিবাসী বিষয়ক সংসদীয় ককাস-এর সদস্য উষাতন তালুকদার এমপি, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদ-এর ডীন অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম, জাতীয় মানবাধিকার কমিশন-এর সদস্য অধ্যাপক বাঞ্ছিতা চাকমা, অক্সফ্যাম-এর প্রোগ্রাম ডিরেক্টর এম বি আক্তার, এবং বাংলাদেশ আদিবাসী ফোরাম-এর সাধারণ সম্পাদক সঞ্জীব দ্রং। অনুষ্ঠানের শুরুতে কাপেং ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক ও ‘বাংলাদেশের আদিবাসীদের মানবাধিকার রিপোর্ট ২০১৭’-এর অন্যতম সম্পাদক পল্লব চাকমা স্বাগত বক্তব্য দেন এবং প্রতিবেদনের সামগ্রিক রূপ সংক্ষিপ্তাকারে তুলে ধরেন।
অনুষ্ঠানে কাপেং ফাউন্ডেশনের সদস্য সোহেল হাজং-এর সঞ্চালনায় প্রধান অতিথি, সম্মনিত অতিথি ছাড়াও মুক্ত আলোচনায় মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার বিভিন্ন অঞ্চলের আদিবাসী ভিকটিমরা অংশগ্রহণ করেন।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে সুলতানা কামাল বলেন- দেশে এক প্রকার যে অধিকারহীনতা ও বিচারহীনতার সংস্কৃতি চলমান রয়েছে তা মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে আসা এ দেশে হতে দেয়া যাবে না। এই প্লাটফর্ম থেকেই আমাদের বিচারহীনতা সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলতে হবে। দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটতেই থাকবে আর সবাই বলবে আমাদের করার কিছু নেই এটা হতে দেয়া যায় না। আদিবাসী মানুষের সমস্যা শুধু তাদের সমস্যা না এটা দেশের প্রতিটা বিবেক সম্পন্ন মানুষের সমস্যা। এ সমস্যার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে হবে।
সুলতানা কামাল আরো বলেন, বঙ্গবন্ধু ঐতিহাসিক ৭ মার্চ বক্তব্যে বলেছিলেন ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোল এবং প্রত্যেকটা মানুষ যেন তার এই অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সচেষ্ট থাকে, কাজ করে। তিনি এক জায়গায় বলেছিলেন, আওয়ামীলীগের নেতৃত্বে মহল্লায় মহল্লায় সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কথা। সেটা কি ভূমি দখল, বিচারহীনতা ও নারীর ওপর নির্যাতনের জন্য সংগ্রাম পরিষদ গড়ে তোলার কথা ছিল না এসব ঘটনা যেন না হয় তার জন্য! সরকারের কাছে একটি প্রশ্ন এখন যারা নেতৃত্বে আছেন এবং বঙ্গবন্ধুর দল বলে সকল সুযোগ সুবিধার দাবি করেন সেই জায়গা থেকে তাদের যে দায়িত্ব সেটা কেন পালন করেন না। তিনি বলেন, কেউ নাগরিক সমাজের অধিকারকে খর্ব করতে পারে না কারণ মুক্তিযুদ্ধ ছিল একটি জনযুদ্ধ। তিনি সবাইকে ঐক্যবদ্ধভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কাজ করার জন্য এগিয়ে আসতে বলেন।
ঊষাতন তালুকদার এমপি বলেন, আমরা ভিডিও ফুটেজে দেখেছি, গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বাগদা ফার্মে পুলিশ সরাসরি গিয়ে আদিবাসীদের ঘরে আগুন লাগিয়ে দিয়েছেন। আইন সেখানে অন্ধ। তাই আইন ব্যবস্থা ও রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য। পার্বত্য চট্টগ্রামে লাদেন গ্রুপসহ বিভিন্ন কোম্পানী প্রশাসনের সহযোগিতায় আদিবাসীদের ভূমি কেড়ে নিচ্ছে, আদিবাসীদের উচ্ছেদ করছে। সাধারণ নাগরিক সেখানে অসহায়। সরকারও যদি সেখানে নিরুপায় হয় তাহলে সরকার কিভাবে কাজ করবে বলে তিনি প্রশ্ন উত্থাপন করেন।
অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, আদিবাসীদের প্রথাগত ভূমি অধিকারের বিষয়টি দেখতে হবে। তারপর আদিবাসী নারী যারা প্রতিনিয়ত মানবাধিকার লঙ্ঘনের শিকার হচ্ছে। দুইজন মারমা মেয়ে পার্বত্য চট্টগ্রামে শ্লীলতাহানির শিকার হয়েছে আবার কিছুদিন আগে আদিবাসী ২ জন নারীনেত্রী অপহরণের শিকার হয়েছে। তিনি সরকারের কাছে আবেদন জানান একটি বিষয়ে নজর দেয়ার জন্য, তা হলো: দেশ এখন উন্নয়নশীল রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে, আমরা উন্নয়ন নিয়ে কথা বলছি কিন্তু সেই উন্নয়ন যদি সমাজের অন্যান্য ঘটনার সাথে সমান তালে না চলে তাহলে আমাদের উন্নয়নশীল দেশের ধারায় চলতে গিয়ে অনেক ধরনের প্রতিবন্ধকতার শিকার হতে হবে। সুতরাং আদিবাসী নারীর প্রতি সহিসংসতা বন্ধ করতে হবে।
অধ্যাপক বাঞ্চিতা চাকমা বলেন পার্বত্য চট্টগ্রামে বেশিরভাগ মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনা ঘটে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী দ্বারাই। কিন্তু নিরাপত্তা বা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা সংঘাটত কোন ঘটনার তদন্ত করা যাবে না-দেশের এমন আইন সংশোধন করতে হবে।
এম বি আক্তার বলেন, দেশে ধর্মীয় মৌলবাদ ও উগ্র জাতীয়তাবাদ একসাথে উত্থাপিত হওয়ার ফলে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন বেড়ে চলেছে। আদিবাসীদের ওপর বহু মামলা হচ্ছে, এ মিথ্যে মামলায় পড়ে অনেক আদিবাসী তাদের ভূমি হারাচ্ছে। এর বিরুদ্ধে আদিবাসীদের শক্তি গড়ে তোলতে হবে এবং শক্তির প্রকাশ ঘটাতে হবে।
সঞ্জীব দ্রং বলেন, দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে কিন্তু বিচার হবে না এটা হতে পারে না। কয়েক বছর আগে ঢাকা শহরে একজন গারো মেয়ে মাইক্রোবাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছিল কিন্তু এখন সে মেয়ে বা মামলার কি অবস্থা সে খবর আমরা কেউ রাখি না। আমরা চাই, সরকার যেন এ প্রতিবেদন ইতিবাচকভাবে গ্রহণ করে পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণে উৎসাহী হয়।
সভাপতির বক্তব্যে জাতীয় আদিবাসী পরিষদের সভাপতি রবীন্দ্রনাথ সরেন বলেন, শুধু পার্বত্য চট্টগ্রামে নয় সমতলের বিভিন্ন অঞ্চলে গ্রামের পর গ্রাম আদিবাসীরা নিজ ভূমি হতে উচ্ছেদ হচ্ছে এবং দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হচ্ছে। তারা কোথায় যাচ্ছে, কেন যাচ্ছে সরকারকে তা খুঁজে বের করতে হবে। এটা রাজনৈতিক সমস্যা রাজনৈতিকভাবে মোকাবেলা করতে হবে।
কাপেং ফাউন্ডেশন তার প্রকাশিত প্রতিবেদনে তোলে ধরে যে, ২০১৭ সালের আদিবাসীদের সার্বিক মানবাধিকার-পরিস্থিতি ছিল খুবই উদ্বেগজনক। এ বছরটিতে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে অপহরণ, গুম ও বিচার-বহির্ভূত হত্যাকান্ডের পাশাপাশি বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের নিখোঁজ হওয়ার ঘটনা জনমনে চরম উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি করেছে। বিশেষ করে পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসী অধিকার কর্মীদেরকে চাঁদাবাজি, অস্ত্রধারী, সন্ত্রাসী ইত্যাদি সাজানো অভিযোগে অভিযুক্ত করে মিথ্যা মামলা দায়ের, ধরপাকড়, জেলে প্রেরণ, ক্যাম্পে আটক ও নির্যাতন, ঘরবাড়ি তল্লাসী ইত্যাদি নিপীড়ন-নির্যাতন জোরদার করেছে। কাপেং ফাউন্ডেশনের তথ্যানুযায়ী, ২০১৭ সালে অন্তত পার্বত্য চট্টগ্রামের ৭ জনসহ সারাদেশে ১০ জন আদিবাসীকে হত্যা, পার্বত্য চট্টগ্রামে ১৪১ জন আদিবাসী অধিকার কর্মী ও নিরীহ গ্রামবাসীকে গ্রেফতার ও সাময়িক আটক এবং ১৬১ জনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা দায়ের করা হয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামে আইন-শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী কর্তৃক নিপীড়ন-নির্যাতন ও হামলায় ২০৩ জন আহত এবং ৭৯টি ঘরবাড়িতে তল্লাশী চালানো হয়েছে।
কাপেং ফাউন্ডেশন জানিয়েছে, নৃশংসভাবে মারধর করার ফলে গুরুতর আহত হওয়ায় পুলিশ গ্রহণ করতে অপরাগতা জানিয়েছে এমন ধরনের অন্তত তিনটি ঘটনা ঘটেছে। এ ধরনের একটি উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো রমেল চাকমা’র নিরাপত্তা হেফাজতে মৃত্যু। এইচএসসি পরীক্ষার্থী রমেল চাকমাকে নিরাপত্তা বাহিনী আটক করলে আহত অবস্থায় পুলিশ গ্রহণ না করাতে ৫ এপ্রিল ২০১৭ তারিখে নানিয়ারচরে ধৃত নিরাপত্তা বাহিনীর হেফাজতে রেখেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় ১৯ এপ্রিল তাঁর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটে। এ অমানবিক ঘটনার সাথে জড়িত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে কোন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
আরেকটি বড় উদ্বেগের বিষয় হল: ২০১৭ সালে বাংলাদেশের আদিবাসীদের প্রায় ২০ হাজার একর জমি অধিগ্রহণ বা অধিগ্রহণের প্রক্রিয়ার চলে যায় সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অধীনে। যার ফলে সমতল ও পার্বত্য চট্টগ্রামের প্রায় ১২ হাজার ১৯৫টি পরিবার-এর জীবন হুমকীতে রয়েছে যার মধ্যে অধিকাংশই এখনও উচ্ছেদের আতঙ্কে রয়েছে। মোট ২৫০ ঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে যার মধ্যে পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৩৭ টি এবং সমতলে ১৩টি। ভ’মি কেন্দ্রিক মিথ্যে মামলা হয়েছে মোট ২৮৫জন আদিবাসীর বিরুদ্ধে। শুধুমাত্র বিজিবি এবং নিরাপত্তাবাহিনী দ্বারা ভূমি অধিগ্রহণের ঘটনা ঘটেছে বা প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে পার্বত্যাঞ্চলের ১০৯০ একর জমি। ২০১৬ সালের অক্টোবরে সরকার পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদের সুপারিশমালা মোতাবেক পার্বত্য চট্টগ্রাম ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি কমিশন আইন ২০০১ সংশোধন করে। কিন্তু ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করার জন্য আইনটি বাস্তবায়নে এখনও অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। সরকারের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও সমতলের আদিবাসীদের ভূমিকেন্দ্রিক সমস্যাগুলির সমাধান বা ভূমি সমস্যা মোকাবেলার জন্য একটি পৃথক ভূমি কমিশন গঠনের উদ্যোগ সরকার আজও গ্রহণ করতে পারেনি।
লংগদু ঘটনা: গত বছরের ২ জুন রাঙ্গামাটি পার্বত্য জেলার লংগদু উপজেলায় আদিবাসী জনগোষ্ঠীর উপর সেটেলার বাঙালি দ্বারা সংঘটিত অগ্নিসংযোগ, লুটপাট ও উচ্ছেদের ঘটনাটি ছিল অত্যন্ত ভয়াবহ। এ ঘটনায় আদিবাসী গ্রামবাসীদের প্রায় ২৫০টি ঘরবাড়ি এবং দোকান ভাংচুর এবং লুটপাট করা হয়েছিল। গুণমালা চাকমা (৭৫) নামে এক বৃদ্ধ মহিলাকে এই অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আগুণে পুড়িয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এছাড়া ৩ জন আদিবাসী গ্রামবাসী এ হামলায় আহত হয়।
২০১৭ সালের ১ জানুয়ুারি থেকে ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আদিবাসী নারীর বিরুদ্ধে সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে মোট ৪৮টি (সমতলে ২০টি এবং পার্বত্য চট্টগ্রামে ২৮টি)। ৪৮টি ঘটনায় মোট ৫৮ জন আদিবাসী নারী ও মেয়েশিশু যৌন বা শারীরিকভাবে আক্রমণের শিকার হয়। যার মধ্যে, ৯ জন আদিবাসী নারীকে হত্যা ও ধর্ষণের পর হত্যা করা হয় যা গত ১০ বছরে মানবাধিকার লঙ্ঘণের সর্বোচ্চ রেকর্ড এটি। এবং কমপক্ষে ১২ জন আদিবাসী নারী ধর্ষণের শিকার হয়
এবং ৯ জন নারীকে শ্লীলতাহানি বা ধর্ষণের চেষ্টা করা হয়। অন্যান্য ঘটনার মধ্যে ৪ আদিবাসী নারী গণধর্ষণ এবং ৮ জন আদিবাসী নারী ও কিশোরীকে অপহরণ করা হয় ২০১৭ সালে। এ বছরেও আদিবাসী নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ করার জন্য বাংলাদেশে কোন বিশেষ বা কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়নি।
বাংলাদেশে আদিবাসী শিশু ও যুবদের সার্বিক মানবাধিকার পরিস্থিতি বিগত বছরের ন্যায় বিরাজমান ছিল। চট্টগ্রাম জেলার সীতাকুন্ডে ১০টি আদিবাসী শিশু অজ্ঞাত রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরণ করে। এটি ছিল একটি চরম হতাশার খবর।
কাপেং আরো জানায়, শিক্ষানীতি ২০১০-এর আলোকে প্রণীত আদিবাসী শিশুদের নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা বাস্তবায়নে সরকারের প্রচেষ্ঠা অব্যাহত ছিল। আদিবাসীদের জন্য নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষা ব্যবস্থা চালু হলেও সরকার সম্পূর্ণ প্রক্রিয়াটি যথাযথভাবে কার্যকর করতে পারেনি। যেমন- অপর্যাপ্ত পাঠ্যপুস্তক বিতরণ ও পুরো আদিবাসী অধ্যুষিত এলাকা আওতায় না আনা, সংশ্লিষ্ট আদিবাসী ভাষায় দক্ষ শিক্ষক ও শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের অভাব এবং উক্ত ভাষাভাষী আদিবাসী শিক্ষার্থীদের এ কার্যক্রমের সঠিক হিসেবে না আনা ইত্যাদি। পার্বত্য চট্টগ্রামসহ সমতলের অনেক ছাত্রছাত্রী’ই ২০১৭ সালে প্রথমবারের মত প্রচলিত নিজস্ব মাতৃভাষায় প্রাক্-প্রাথমিক শিক্ষার পাঠ্যপুস্তক পায়নি। বহুবছরের প্রচেষ্টার পর অবশেষে মন্ত্রণালয় ২০১৭ সালের ১লা জানুয়ারি সারাদেশে সাঁওতালি বাদে অন্য পাঁচটি ভাষায় ৫০,০০০ প্রাক-প্রাথমিক পাঠ্যপুস্তক বিতরণ করে। আনুমানিক মাত্র ২৫,০০০ আদিবাসী শিশু বিতরণকৃত এ পাঠ্যপুস্তকগুলো হাতে পেয়েছে।
পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি বাস্তবায়ন সম্পর্কে বলা হয়, সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করে যে তারা চুক্তির ৭২টি ধারার মধ্যে ৪৮টির পূর্ণ বাস্তবায়ন ও ১৫টি ধারা আংশিক বাস্তবায়ন করেছে। বাকি ৯টি ধারাও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে রয়েছে। অথচ চুক্তির মূল বিষয়গুলো যথা পার্বত্য চট্টগ্রামে পাহাড়ি অধ্যুষিত অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য সংরক্ষণে প্রশাসনিক ও আইনগত পদক্ষেপ; সাধারণ প্রশাসন, আইন-শৃঙ্খলা ও পুলিশ সহ ভূমি ও ভূমি ব্যাবস্থাপনা, বন ও পরিবেশ এবং যোগাযোগ ব্যাবস্থার মত বিষয়গুলো পার্বত্য চট্টগ্রাম আঞ্চলিক পরিষদ ও তিন জেলা পরিষদের কাছে হস্তান্তর; ভূমি কমিশনের মাধ্যমে ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করে বেদখলকৃত জমিগুলো প্রকৃত মালিকের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া; ভারত প্রত্যাগত শরণার্থী ও অভ্যন্তরীণ পাহাড়ি উদ্বাস্তুদের যথাযথ পুনর্বাসন করা; অপারেশন উত্তরণ সহ পার্বত্য অঞ্চল থেকে সকল অস্থায়ী সেনাক্যাম্প প্রত্যাহার করা; ও অস্থায়ী বাসিন্দাদের কাছে দেওয়া লীজ বাতিল করা ইত্যাদি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো হয় একবারেই বাস্তবায়িত হয়নি নতুবা আংশিক বাস্তবায়িত হয়েছে।
২০১৭ সালে দেশের পার্বত্য ৩ জেলায় ভূমিধসের কারণে অনেক আদিবাসী ও অআদিবাসী নারী ও শিশুসহ কমপক্ষে ১৩১ জন লোক মারা গেছে। কেবল রাঙ্গামাটি জেলায় ১২১ জনের মৃত্যু হয়েছে, অপরপক্ষে খাগড়াছড়ি জেলায় ৪ জন এবং বান্দরবান জেলায় ৬ জনের মৃত্যু হয়েছে। রাঙ্গামাটি জেলায় দুইজন অফিসারসহ ৪ সেনা সদস্য মারা গেছে। নিহতদের মধ্যে রাঙ্গামাটি সদর উপজেলায় মানিকছড়ি, ভেদভেদী ও রিজার্ভ বাজার এলাকায় ৪৫ জন মারা গেছে। অপরপক্ষে রাঙ্গামাটি জেলার কাউখালী, কাপ্তাই, বিলাইছড়ি ও জুরাছড়ি উপজেলায় ৪৭ জনের মৃত্যু ঘটে।
সূত্র: প্রেস বিজ্ঞপ্তি।