২০ ডিসেম্বর, মালয়েশিয়ার কুয়ালালামপুর বিমানবন্দর। একাধিক যুগ্ম সচিবসহ ১২ সরকারি কর্মকর্তা খাদ্যের মান দেখতে সরকারি সফরে সেখানে গেছেন। দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরে সফর শেষ করে মালয়েশিয়া পৌঁছান তারা। সফররত সবার সরকারি পাসপোর্ট এবং সফরও ছিল সরকারি। বাংলাদেশ ও মালয়েশিয়ার দ্বিপক্ষীয় আনুষ্ঠানিক চুক্তি অনুসারে তারা সবাই কুয়ালালামপুর এয়ারপোর্টের ইমিগ্রেশন কাউন্টারে অন অ্যারাইভ্যাল ভিসা পাবেন আমন্ত্রণকারী মালয়েশিয়ার সরকারি দফতরের এমন লিখিত বার্তা নিয়েই যান সেখানে। প্রতিনিধি দলের একজন সিনিয়র যুগ্ম সচিব মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন অফিসারের কাছে নিজেদের পরিচয় দিতেই ওই নারী কর্মকর্তা বলে ওঠেন ‘গো, গো আউট ফ্রম হেয়ার’। ভিসা না দিয়ে সরকারি কর্মকর্তাদের দলটিকে মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশন পুলিশের হাতে তুলে দেওয়া হয়। শুরু হয় নানান দুর্ব্যবহার। গত ১৩ নভেম্বর মালিন্দো এয়ারলাইনসের ওডি-১৬৫ ফ্লাইটে ঢাকা থেকে বৈধ ভিসা নিয়ে কেএলএআইতে পৌঁছান একটি বহুজাতিক টেলিকম কোম্পানির এইচ আর ম্যানেজার এবং বাংলাদেশি করপোরেট প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজার পদমর্যাদার প্রকৌশলী দুই বন্ধু। সাত দিনের জন্য ঘুরতে গিয়েছিলেন মালয়েশিয়ায়। কিন্তু বিধি বাম এয়ারপোর্টেই। লজ্জায় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই বন্ধু বলেন, আমরা দুজনই ভারত, নেপাল, মিয়ানমার ও চীন সফর করেছি। পাসপোর্টে তিন দেশের ভিসাও ছিল। অথচ সেখানকার এক তামিল বংশীয় ইমিগ্রেশন কর্মকর্তা আমাদের কাছ থেকে পাসপোর্ট টিকিট নিয়ে আমাদের ৩ ঘণ্টা বসিয়ে রেখে অন্যায়ভাবে ডিটেনশন ক্যাম্পে পাঠিয়ে দেয় এবং ৫ তারিখের ফ্লাইটে আমাদেরসহ ওই দিনের ফ্লাইটে যাওয়া ৯০ শতাংশ যাত্রীকে ফেরত পাঠানো হয়। তারা এই অমানবিক আচরণের অবসান চান মালয়েশিয়া সরকারের কাছে। তারা মনে করেন, বাংলাদেশ সরকারের উচিত তার নাগরিকদের অসম্মানের হাত থেকে বাঁচাতে মালয়েশিয়ার প্রতি চাপ সৃষ্টি করা।
ঢাকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী সিজার জানান, গত ২৪ নভেম্বর ভোরে কেএলআইএ এয়ারপোর্টে নামি। কিন্তু ফ্লাইট থেকে নামতে দেরি, ইমিগ্রেশন পুলিশ ধরতে দেরি নেই। একই ফ্লাইটের যাত্রী ব্যাংক কর্মকর্তা শাহনেওয়াজ জানান, লাইন ধরে আমাদের বিশেষ ইমিগ্রেশন কাউন্টারে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে মিয়ানমার ও ভিয়েতনাম এবং আফ্রিকা অঞ্চলের যাত্রীরা ছিলেন। সেখানে লম্বা লাইন দেখে এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ফ্লোরে বসার জন্য। বসতে হয়েছে। তিনি বলেন, নানা ধরনের অপমানজনক প্রশ্ন করছিল। ট্যুরিস্ট ভিসার যাত্রীদেরও এই হয়রানি করা হচ্ছিল। শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ইউসুফ জানিয়েছেন, কোনো কোনো ফ্লাইটের ৯০ শতাংশ যাত্রী ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ইমিগ্রেশন পার হতে না পারা যাত্রীরা দেশে এসে তাদের লাগেজও পাচ্ছেন না। বিমানবন্দর ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে প্রতিনিয়তই এ ধরনের ফেরত যাত্রীরা ভিড় জমাচ্ছেন। ১২ সরকারি কর্মকর্তার প্রতিনিধি দলে থাকা খাদ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব মাহবুব কবির মিলন আক্ষেপ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে লিখেছেন, কয়েক বছর আগে একবার মালয়েশিয়া গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন এমন দেখিনি। দিন দিন বাংলাদেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি ও বাংলাদেশ-মালয়েশিয়ার দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের উন্নতি হয়েছে, কিন্তু মানসম্মানের হয়েছে কিনা তা নিয়ে তার প্রশ্ন আছে। বাংলাদেশি অভিবাসী যারা মালয়েশিয়ায় বিভিন্ন ধরনের কাজে নিয়োজিত আছেন তাদের বিষয়েও উদ্বিগ্ন এই কর্মকর্তা। তার মতে, ‘এই দেশে আমাদের সঙ্গে এমন ব্যবহার করলে, এরা কী অবস্থায় আছে, তা কল্পনা করলেও গা শিউরে ওঠে।’
জানা যায়, অবৈধভাবে অবস্থানের উদ্দেশে মালয়েশিয়া আগমন ঠেকাতে কঠোর হওয়া কুয়ালালামপুর বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তারা এখন বাংলাদেশি পাসপোর্ট দেখামাত্র দুর্ব্যবহার করছে। ফ্লাইট থেকে নেমে এয়ারপোর্ট ইমিগ্রেশনের লাইনে যেতেই শুরু হয় ভোগান্তির। অন্য সব দেশের নাগরিকরা এক লাইনে থেকে ইমিগ্রেশনের আনুষ্ঠানিকতা শেষ করতে পারলেও বাংলাদেশিদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে আলাদা লাইনে। একই ফ্লাইটের অন্যান্য দেশের যাত্রীরা ১০ মিনিটে এয়ারপোর্ট ছাড়তে পারলেও বাংলাদেশিদের লাগছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। পাসপোর্ট ও অন্যান্য কাগজপত্র ঘণ্টার পর ঘণ্টা কোনো কারণ দর্শানো ছাড়া কাউন্টারে রাখা হচ্ছে। কিছু জানতে চাইলে করা হচ্ছে দুর্ব্যবহার। কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে রেখে বেশির ভাগ বাংলাদেশির আলাদা ইন্টারভিউ নিচ্ছে সেখানকার কর্তৃপক্ষ। এই ইন্টারভিউ প্রায় শতভাগ ক্ষেত্রেই অপরাধীকে জিজ্ঞাসাবাদের আদল পাচ্ছে। বিনা কারণে বাতিল করে দেওয়া হচ্ছে প্রবেশাধিকার। ইমিগ্রেশনের ডিটেনশনে আটকে রাখার পর ফিরতি কোনো ফ্লাইটে টিকিট কেটে ফেরত পাঠাতে বাধ্য করা হচ্ছে। পুত্রজায়ায় এক দশকের বেশি অবস্থান করা প্রবাসী সাদী আল মাহমুদ বলেন, ‘মালয়েশিয়ার ইমিগ্রেশনে কাজের জন্য আসা অভিবাসী শ্রমিকদের এক ধরনের ভোগান্তি সব সমই ছিল। কিন্তু গত বছরখানেক ধরে এই ভোগান্তি সব মাত্রা ছাড়িয়েছে। এখন নির্যাতনের ঘটনাও ঘটছে।’ তিনি বলেন, পছন্দ হলে এন্ট্রি সিল দেওয়া হচ্ছে, নয়তো আটক করে বিমানবন্দরের ভিতরের ইমিগ্রেশন ক্যাম্পে (হাজতে) ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে। পরে ফিরতি টিকিটের দিন দেশে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হচ্ছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে যারা ১০ দিনের ভ্রমণ পরিকল্পনা নিয়ে মালয়েশিয়া গেছেন, তাদের প্রায় ১০ দিনই জেল খাটতে হয়েছে। যোগাযোগ করা হলে কুয়ালালামপুরে বাংলাদেশের হাইকমিশনের মধ্যম সারির এক কর্মকর্তা জানান, হাইকমিশন এই বিষয়টি বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে দেখছে। ডিসেম্বরের শেষ সপ্তাহেও হাইকমিশনারের সঙ্গে মালয়েশিয়া ইমিগ্রেশন দফতরের প্রধানের দীর্ঘ বৈঠক হয়েছে। সেখানে অন্যান্য বিষয়ের পাশাপাশি ভোগান্তির বিষয়গুলোও তোলা হয়েছে। তারা আশ্বাস দিয়েছে এমন না হওয়ার।