বেশ কিছুদিন ধরে এক আচ্ছন্নতা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। তা হল কোন এক পূর্ণিমা রাতে এক অচেনা সরোবরের তীরে বসে জ্যোৎস্না উপভোগ করব, নির্জনতা উপভোগ করব। সেই মতো এক সরোবর খুঁজে বেরও করলাম, কিন্তু তার নাম এতো কঠিন যে জিভ প্রায় জড়িয়ে যায়। মনে মনে তাকে নাম দিলাম পূর্ণিমা সরোবর। আর বণী, জহির ও এমরানকে নিয়ে একটা ট্যুর প্লানও করে ফেললাম। পূর্ণিমা সামনে রেখে আমরা বের হয়ে পড়লাম। কেবল এমরান শেষ পর্যন্ত আমাদের সাথে যোগ দিতে পারল না। পিঠে ব্যাগ আর এমরানের জন্য মন খারাপ নিয়ে ট্রেনে উঠলাম তিনজন। ট্রেন চট্টগ্রাম পর্যন্ত, তারপর বাসে করে বান্দরবান।
বান্দরবান পৌঁছতে পৌঁছতে প্রায় আট বেজে গেল। বাস থেকে নেমে রুমা বাস স্টেশনের উদ্দেশ্যে অটোতে চেপে বসলাম। শীতের সকাল, লোকজন কম, বাস ছাড়তে দেরি হবে। তাই আমরা ঐ বাস স্টেশনেই চা বিস্কুট খেয়ে নিলাম। লক্ষণীয় ব্যাপার হলো, এখানে বাস স্ট্যান্ডকে স্টেশন বলা হয়। যাই হোক বাস শহর ছেড়ে কিছু দূর আসতেই নাকে এসে লাগলো পাহাড়ি জঙ্গলের বুনোগন্ধ। কেন যেন মনে হয় এই গন্ধের মধ্যে আমার শৈশব লুকিয়ে আছে। বেলা একটা নাগাদ রুমা বাজারে পৌঁছলাম।
রুমা বাজারে খাওয়া দাওয়া করে একটু বিশ্রাম নিয়ে গাইডদের সাথে কথা বলতেই মন খারাপ হয়ে গেল। কেননা, রাইংক্ষ্যংপুকুর আর দুমলং-এর রাস্তা টুরিস্টদের জন্য বন্ধ, কোন ভাবেই যাওয়ার অনুমতি পাওয়া গেল না। আপাতত আর্মি, থানা পুলিশের সব শর্ত পূরণ করে জিপে উঠলাম বগা লেকের উদ্দেশ্যে। সাথে আমাদের গাইড সাপুড়ে’দা। সাপুড়ে’দা মানে তার পুরো নাম শাপুল বড়ুয়া, স্থানীয়দের ডাক শুনতে মনে হয় সাপুড়ে। সন্ধ্যার মুখে জিপ আমাদের নামিয়ে দিল কমলা পাড়ায়। এরপর পাহাড় বেয়ে উঠতে হবে বগালেক। বগালেক পাহাড়ের উপরে উঠে আবার নতুন করে মুগ্ধ হলাম।
পাহাড়ের উঁচু নিচু ভাঁজে ভাঁজে গোধূলির আলো আর অঘ্রাণের কুয়াশা অদ্ভুত এক মায়ার খেলা খেলছে। দিনের আলো পুরোপুরি না ফুরানো পর্যন্ত আমরা ঐ পাহাড়ের ওপরে বসে পাহাড়ি সন্ধ্যার সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম। এরপর বগালেক আর্মি ক্যাম্পে এন্ট্রি করে আমরা পাড়ায় আসলাম। সাপুড়ে’দা আমাদের রবার্টের ঘরে থাকার ব্যবস্থা করল। আমরা ব্যাগ ব্যাগেজ ঘরে রেখে চলে গেলাম লেকে। তবে ঐ সন্ধ্যায় আমি স্নান করলাম না। কারণ খুব দ্রুত চারপাশের পরিবেশ ঠান্ডা হয়ে গেল। কেবল টুরিস্টদের হৈ হুল্লোড় বগার পরিবেশকে বারবার বিপন্ন করছে। আমরা হাতমুখ ধোয়ার জন্য লেকের কিনারে গিয়ে দেখি চাঁদের আলোয় লেক চকচক করছে। পাহাড়ের প্রতিবিম্ব টলমল করছে লেকের আয়নায়। লেক থেকে ফিরে দেখি সাপুড়ে’দা আউট অব কন্ট্রোল, পেটে লিকার পড়েছে। বেলাল, নিউটন, ফতেসহ কয়েকজনের আড্ডা বেশ জমে গেছে।
বলতে গেলে প্রায় ছত্রিশ ঘন্টা ঘুমহীন যাত্রা, তাই শরীর ভীষণ ক্লান্ত। বগালেকে ওঠার পরে ভেবে নিয়েছি খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ব। কিন্তু পাহাড়ের নির্মল হাওয়া গায়ে মাখতেই সমস্ত ক্লান্তি হারিয়ে গেল, আবার চনমনে হয়ে উঠলাম। রাতে আমাদের থাকার জায়গা হলো কাঠের দোতলায়, ঢালা বিছানা যেমন খুশি শুয়ে ঘুমাও। খেয়েই শুয়ে পড়ব ভেবেছিলাম, কিন্তু বারান্দার দরজা খুলে দেখি বাইরে যাদুকরী জ্যোৎস্না নেমেছে। আমার কল্পজগতে সিদ্ধার্থের জীবনের পূর্ণিমা রাতগুলো যেন ভেসে উঠল। মনে হলো, সংসারের চেয়ে জ্যোস্নার মায়া আরো দূর্নিবার। সেই মায়া নেশার মতো। এ নেশা যাকে পায় তাকে সংসার থেকে তুলে নেয়। আমরা তিনজন ঘর থেকে বাইরে বের হয়ে এলাম।
বাইরে বেশ ঠান্ডা, তাই টুরিস্টদের অযাচিত হৈ হুল্লোড় নেই। একেবারে নিস্তব্ধ চারিদিক। আমরা একটা ছাউনীর নিচে বসে চারিদিক দেখছি। এতো পরিষ্কার পূর্ণিমার আলো জীবনে কখনো দেখেনি। চারিদিকের নিস্তব্ধ পাহাড়ে লুটোপুটি খাচ্ছে চাঁদের আলো। আমার মন বেদনায় হুহু করে উঠল, এতো কাছে এসেও দেখবোনা পূর্ণিমা সরোবর! এমন সময় দেখি সাপুড়ে’দা বাজখাঁই গলায় গান গাইতে গাইতে আমাদের দিকে আসছে। আমাদের দেখে জানতে চাইল আমরা এখানে কেন? ওদিকে আগুন জ্বালানো হয়েছে, সেখানে চলেন।
আমরা সাপুড়ে’দার সাথে আগুন পোহাতে চললাম। গিয়ে দেখি সেখানে নিউটন, বেলাল, ফতেং আগুন ঘিরে বসে আছে। তারপর আগুনে উত্তপ্ত হয়ে আমি এক চরম প্রস্তাব করে বসেলাম। আগমীকাল রাতে কোথাও কাউকে কিছু না জানিয়ে আমরা পূর্ণিমা সরোবর দেখতে চলে যাব। আমাকে বণী আর জহির সাথে সাথে সর্মথন দিল। নিউটন আমার প্রস্তাব শুনে হা হয়ে গেল আর সাপুড়ে’দা না হু না হু করতেই তার গ্লাসে বেলাল আরেকটু ঢেলে দিল। ব্যস চুমুক দিয়ে, শুরু হয়ে গালাগালি। গালাগালি দিয়ে আর্মিদের শ্রাদ্ধ করে দিল, তারপর সাপুড়ে’দার বক্তব্য- আমরা স্বাধীন, স্বাধীন না? আমরা সমবেত ভাবে বললাম অবশ্যই স্বাধীন। এবার সাপুড়ে’দা সিদ্ধান্ত দিল- স্বাধীন দেশে যেখানে খুশি আমরা সেখানে যাব, কেউ আমাদের বাধা দেবার নেই। সিদ্ধান্ত হয়ে গেল, পরদিন দুপুরের পরে আমরা একে একে জঙ্গলে ঢুকে পড়ব। নিউটনের বাড়তি দায়িত্ব হলো সে তার বন্দুকটা সাথে নেবে।
পরদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গল দেরিতে। বাইরে বেরিয়ে দেখি ঝাঁ চকচকে রোদ। টুরিস্টরা সব চলে গেছে কেওক্রাডং-এর দিকে, আর অনেকে ফিরে গেছে নিজ নিজ ঠিকানায়। তাই বগালেকের সকালটা খুব শান্ত মনে হলো। আমরা হাত মুখ ধোয়ার জন্য লেকে নামলাম। লেকের পানি একেবারে নিটোল স্বচ্ছ, অনেক ছোট ছোট মাছ খেলা করছে পানির মধ্যে। লেক থেকে হাতমুখ ধুয়ে ফিরেই দেখি রবার্ট আমাদের জন্য খাবার রেডি করে রেখেছে। খেয়ে সাপুড়ে’দা আর নিউটনকে নিয়ে বসলাম, বসে পরামর্শ সেরে নিলাম আমরা কিভাবে পূর্ণিমা সরোবর যাবো। তারপর কিছু বিস্কুট আর প্রত্যেকে এক প্যাকেট গ্লুকোজ নিয়ে আর্মি ক্যাম্পে গিয়ে ইনফর্ম করলাম আমরা কেওক্রাডং যাচ্ছি। এসব প্রস্তুতি নিতে নিতে প্রায় দুপুর হয়ে গেল। আমরা আর্মি ক্যাম্প থেকে বের হয়ে কেওক্রাডংয়ের পথ ধরলাম।
জঙ্গলের মধ্যে কিছুদূর যাবার পর আমরা কেওক্রাডংয়ের পথ ছেড়ে আমাদের স্বপ্নের সরোবরের পথ ধরলাম। একেবারে সামনে নিউটন, তার হাতের চটের ব্যাগের মধ্যে বন্দুক। তারপরে বেলাল, ফতেং, জহির, বনী, আমি আর সবশেষে সাপুড়ে’দা। আমরা পায়ে হাঁটা পথ ধরে এগিয়ে চলেছি। ফতেং তার হাতের দা দিয়ে ঘন জঙ্গল ও লতা কেটে পরিষ্কার করে দিচ্ছে। এই জঙ্গলের পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে মনে হলো যদি আরাকানি বাহিনীর হাতে আটক হই বা শান্তিবাহিনীর হাতে অপহরণ হই তবু হয়তো বাঁচার সম্ভবনা থাকবে। তাদের বুঝিয়ে সুঝিয়ে ফেরত আসা যাবে। কিন্তু সেনাবাহিনীর হাতে আটক হলে বাকি জীবন জেলে-ই কেটে যাবে। তবু পূর্ণিমা সরোবর দেখার অবাধ্য রোমাঞ্চ আমাদের সামনের দিকে নিয়ে গেল।
পথে পথে পাহাড়ের ঢালে নাম না জানা ফুলের বিছানা আর পাখির ডাক আমাদের অভিবাদন জানাল। এইসব দৃশ্য আমাদের শরীরের ক্লান্তিকে বারবার শুষে নিয়েছে। আর পথের ছোট ছোট ঝিরিগুলো আমাদের দেহে শক্তি সঞ্চার করছে। ঝিরি থেকে পানি নিয়ে গ্লুকোজ গুলিয়ে খেয়ে আবার পথ চলছি। এইভাবে ঠিক সন্ধ্যা নাগাদ আমরা পূর্ণিমা সরোবরের নিচে পৌঁছলাম। আমরা গাছগাছালির নিচে অপেক্ষা করতে শুরু করলাম অন্ধকার আরেকটু গাঢ় হবার জন্য। অন্ধকার ঘন হলেই উপরের আর্মি ক্যাম্পের চোখ ফাঁকি দিয়ে দেখা যাবে নয়নাভিরাম পূর্ণিমা সরোবর। আমাদের তিনজনের ভেতরে উত্তেজনার পারদ ডিবডিব করছে।
মাইকেল পুকুর পাড়ার স্থানীয় যুবক যার সাথে নিউটনের ভালো পরিচয় আছে। নিউটন পথে পেয়ে তাকে সাথে নিয়েছিল আগেই। পাড়ায় অচেনা আগন্তুকদের বিড়ম্বনা হওয়া অস্বাভাবিক নয়, বিড়ম্বনা এড়ানোর জন্য বুদ্ধি করে মাইকেলকে সাথে রেখেছে নিউটন। অন্ধকার ঘন হতেই আমরা ক্রমে উপরে উঠতে থাকলাম। একেতো খাড়া পাহাড় তার ওপরে নিষেধ অমান্য করে এগিয়ে যাওয়া। আমাদের ভেতরে উত্তেজনা এবং ভয় একসাথে কাজ করছে। বিশেষ করে আমি তো কোন শব্দ পর্যন্ত করতে পারছিনা।
উপরে উঠে আমরা একটা গাছের নিচে আশ্রয় নিলাম। ঠান্ডা বাতাস এসে আমাদের শরীর জুড়িয়ে দিল অল্প সময়ে মধ্যে। আমাদের সামনে নিষিদ্ধ সরোবর, আমি সরোবরের কিনারে দাঁড়িয়ে। সরোবরের কিনারে দাঁড়িয়ে নিজেকে আমার সৌভাগ্যবান বলে মনে হল। দেখলাম চাঁদনী রাতের এই সরোবরের সৌন্দর্য আমার কল্পনাকে হার মানিয়েছে। বন বনানীতে জ্যোৎস্না গলে পড়ছে। পূর্ণিমার চাঁদটাকে দেখে মনে হলো এইমাত্র বোধ হয় সরোবরের আয়নায় নিজেকে দেখে পরিপাটি হয়ে আকাশে উদিত হলো। মনে হলো প্রতি পূর্ণিমায় চাঁদটা লেকের স্বচ্ছ জলের আয়নায় নিজেকে একবার ঠিকঠাক মতো দেখে নেয়। তারপর আনন্দে আকাশে নিজের রূপে ঝলকায়। মনে হলো হ্রদটা গভীর বেদনায় গম্ভীর আর স্থির হয়ে আছে, চাঁদটার প্রতি তার প্রেম আছে।
মাইকেলের সাথে লেক নিয়ে সামান্য কিছু কথা হলো। বহু বহু যুগ আগে এই লেকের কর্তৃত্ব নিয়ে দুটো গোষ্ঠির মধ্যে ভীষণ সংঘাত হয়েছিল। সে সংঘাত চলেছিল অনেক বছর। তাদের ভাষায় রাইংক্ষ্যাং অর্থ হচ্ছে সংঘাত/বিবাদ/মারামারি। অর্থাৎ রাইংক্ষ্যাং পুকুরের বাংলা দাঁড়ায় বিবাদ পুকুর বা কাজিয়া পুকুর (পাহাড়ি জনগোষ্ঠি লেক বা জলাধারকে সাধারণত পুকুর বলে)। কিন্তু সে রাতে ঐ পুকুরের সৌন্দর্য দেখে মনে হয়েছে এতো সুন্দর পুকুরের নাম মারামারি পুকুর হতে পারে না। তাই আমার কাল্পনিক নামকেই যথার্থ মনে হলো পুর্ণিমা সরোবর। সাপুড়ে এতোক্ষণে ওঠার জন্য তাগাদা দিল। যেতে হবে আরো বহুদূর, দুমলং পাহাড়। আমরা কুয়াশার মায়ায় জড়ানো পুকুরপাড়াকে পেছনে ফেল জঙ্গলের পথ ধরলাম আবার। মাইকেল কিছুটা পথ আমাদের এগিয়ে দিয়ে গেল। আমরা জঙ্গলের পথে হাঁটতে হাঁটতে শুনতে পেলাম মাইকেল গলা ছেড়ে গান গাইছে তার নিজের ভাষায়। সে ভাষা আমি বুঝি না। সে ভাষা আমার ভেতরে শুধু বেদনা জাগায়।
রাত যতো গভীর হচ্ছে জ্যোৎস্নার আলো যেন ততো উজ্জল হচ্ছে। সেই পায়ে হাঁটা পথ ধরে সারিবদ্ধ ভাবে এগিয়ে যাচ্ছি দুমলং পাহাড়ের দিকে। রাস্তায় হাঁটাতে হাঁটতে মনে হলো দুমলং নয় দুর্গম পাহাড়। কোথাও কোন শব্দ নেই, কেবল বাতাসে গাছের পাতা দোলার এক রকম শব্দ পাওয়া যাচ্ছে। কখনো কখনো পথ নেমে যাচ্ছে গভীর খাদে, সেখানে ঘন অন্ধকার। অন্ধকারে এক রকম গা ছমছমে ভয় কাজ করছে। আবার খাঁড়ি থেকে উঠে আসতেই সেই কোমল আলো। তখন আনন্দে ভরে যাচ্ছে মন। মাঝে মাঝে সাপুড়ে’দা তার বেসুরো গলায় গান গেয়ে রাতের পাহাড়ের নিস্তবদ্ধতা ভেঙ্গে দিচ্ছে।
সাপুড়ে’দা গান গাইলেই আমার ভেতরে ভয় জেগে উঠছে। মনে হচ্ছে সাপুড়ে’দার এই গানের শব্দকে আরাকানি বাহিনী বা পাহাড়ে লুকিয়ে থাকা উগ্রপন্থীরা রং সিগন্যাল ভেবে গুলি করে বসতে পারে। আমাদের কাছে একটা বন্দুক আর ছররা গুলি দিয়ে তাদের মোকাবেলা করা সম্ভব না। যদিও অগ্রহায়ণ মাসের মাঝামঝি সময় তবু মনে হচ্ছে পৌষ মাস, একটুখানি বিশ্রাম নিলেই শীতের তীব্রতা বোঝা যাচ্ছে। পূর্ণিমা জ্যোৎস্নার আলো আমাদের মোহগ্রস্ত করে ফেলেছে। সেই মোহে আমরা ছুটে চলেছি দুর্গম পাহাড়ে। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে ফালি ফালি আলো এসে চলার পথে পড়ছে। সেই ফালি ফালি আলো দেহমনে অন্যরকম এক শিহরণ তৈরি করছে। মাঝে মাঝে শুকনো পাতার সর সর শব্দ শোনা যাচ্ছে। মনে হচ্ছি জঙ্গল থেকে বার্মিজ পাইথন বের হয়ে এসে আমাদের পথ আটকাবে এখনি। অথবা পেছন থেকে এসে আমাদের কাউকে টপ করে গিলে খাবে। এতো ঘন জঙ্গল তাতে দুয়েকটা বার্মিজ পাইথন থাকা অসম্ভব না। কেননা একটা সময় এই এলাকা বার্মিজ পাইথনের পিতৃভুমি ছিল।
আমি চারদিকে নজর রেখে পথ হাঁটছি, মাঝে মাঝে সাপুড়ে’দাকে দেখে নিচ্ছি। এই ভাবে চলতে চলতে আমরা একটা পাহাড়ের খাঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে দাঁড়িয়ে পাহাড়ের জ্যোৎস্না দেখছি। এমন সময় সাপুড়ে’দা চাপা গলায় বলে উঠল – শাই… শাই…। ওমনি নিউটন বন্দুক তাক করে নিল। আমরা বুঝতে পারলাম ভয়ংকর কোন ঘটনার মধ্যে আমরা ঢুকে পড়েছি। সাপুড়ে’দা আঙ্গুল তুলে দেখাতেই দেখি সমানে মস্ত এক হাতি। আমি ভীষণ আতঙ্কিত এবং উত্তেজিত হয়ে নিউটনকে বললাম- শুট… শুট … ইট। কিন্তু নিউটন গুলি না করে বন্দুক আমার দিকে বাড়িয়ে দিল। আমি বন্দুক হাতে নিয়ে দেখি বন্দুকের ট্রিগার নেই। যেই দেখলাম বন্দুকের ট্রিগার নেই অমনি আমার আত্মা খাঁচা ছাড়া হয়ে গেল।
সাপুড়ে’দা জাতে মাতাল হলে হবে কি তালে একদম ঠিক। আমাদের পিছনে এনে এক গর্তের মধ্যে নামিয়ে দিল। গর্তটা দেখে মনে হলো বর্ষার দিনে হয়তো এখানে ওয়াটার ফল হয়। গর্তে নামতে গিয়ে আবার আরেক সংশয়, বার্মিজ পাইথন না হলেও কেউটে বা গোখরা এখানে তো অস্বাভাবিক নয়! সাপুড়ে’দা এক রকম ঠেলে আমাদের গর্তে নামিয়ে দিল। সবার আগে আমি, তার ওপর বনী, তার ওপর জহির একে একে সবাই সেই গর্তে আমার ওপর ভর দিয়েছে আত্মরক্ষা করতে। কিচ্ছুক্ষণ পরে ভারে যখন আমার প্রাণ যায় যায় অবস্থা তখন মনে হলো এর চেয়ে হাতির পায়ের নিচে পড়ে পটাশ হওয়া ভালো ছিল।
কতক্ষণ ছিলাম এভাবে মনে নেই, তবে সেই সময় প্রতিটা মুহুর্ত মনে হয়েছিল এক একটি যুগ। এক সময় আমার পিঠের ওপর থেকে বোঝা হালকা হলো। কোন রকমে উপরে তাকিয়ে দেখি আকাশ পরিষ্কার দেখাচ্ছে। হাঁচড়ে পাঁচড়ে ওপরে উঠে এসে দেখি সবাই হাসিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। কারণ খুঁজতে গিয়ে দেখি রাতে আমরা যাকে হাতি ভেবে গর্তে লুকিয়ে ছিলাম, সেটা আসলে হাতি না। একটা গাছে লতাপাতা জড়িয়ে হাতির মতো আকার পেয়েছে। রাতের দেখা হাতিটাকে এই অবস্থায় দেখে মনে হলো সাপুড়ে’দাকে পাড়ানি দিই। শরীরের সমস্ত ক্লান্তি নিয়ে ধপাস করে শুয়ে পড়লাম শিশির ভেজা ঘাসের বিছিনায়। শুয়ে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখি অনিন্দ্য সুন্দর এক আকাশ। মনকে বোঝালাম দুমলং পাহাড়ের চেয়ে এই আকাশ কম কিসে!
[লেখক: রাজীব উল হুদা, জন্ম : ১২ আগষ্ট, ১৯৮২ সালে, গ্রাম: জুনিয়াদহ, উপজেলা: ভেড়ামারা, জেলা: কুষ্টিয়া। পিতা: মৃত শামসুল হুদা, মাতা জেবুন্নেছা। কবিতার প্রতি একটা টান রয়েছে। কিছু ছোট ছোট ভ্রমণ গল্প লেখা হয়েছে, তবে সোস্যাল মিডিয়ার বাইরে কোথাও পাবলিশ হয়নি।]