পাহাড় দাবড়ে বেড়াচ্ছেন নারী বাইকাররা

স্বাচ্ছন্দ্য, আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীনতায় বান্দরবানের পাহাড় দাবড়ে বেড়াচ্ছেন নারী বাইকাররা। গত কয়েক বছরে বান্দরবানের প্রায় অর্ধশতাধিক নারী বাইক চালানো শিখেছেন। জেলা সদর, রোয়াংছড়ি, রুমাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে নারীদের স্বচ্ছন্দ যাতায়াত। পেশাগত এবং পারিবারিক কাজে, কখনোবা স্রেফ দলবেঁধে মজা করার জন্যে তাঁরা দাবড়ে বেড়ান এলাকার অলিগলি, সড়ক-মহসড়ক। বাইক ব্যবহার করে নারীদের যাতায়াতে স্বাচ্ছন্দ্য, আত্মবিশ্বাস এবং স্বাধীনতার কথাগুলো তুলে এনেছেন- ফরিদুল আলম সুমন


সকালে নিজের বাইক চালিয়ে যখন স্কুলে যাই, মনটা তখন এক অদ্ভুত আনন্দ আর আত্মবিশ্বাসে ভরে ওঠে। কারো ওপর নির্ভরশীল না হয়ে স্বাধীনভাবে যাতায়াতের স্বস্তি তো আছেই। মটরবাইক ব্যবহার করে যাতায়াতের প্রতিবন্ধকতা কাটিয়ে ওঠার গল্পটা এভাবেই শোনালেন বান্দরবানের রোয়াংছড়ি উপজেলার কল্পনা তঞ্চঙ্গ্যা। পেশায় তিনি একজন শিক্ষক।

কল্পনা বললেন, বেশ কষ্ট থেকেই বাইক কেনার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। বছর দুয়েক আগে যখন স্কুলের চাকরি হলো, প্রতিদিন যাতায়াতে বেশ ঝামেলা পোহাতে হতো। সময়ও লাগতো বেশি। পরে পরিবারের সদস্যদের সহায়তায় প্রথমে বাইসাইকেল চালানো শিখি। মাত্র একদিনেই সাইকেল চালাতে পেরেছিলাম। তারপর বাইকটা কিনলাম। আমার স্বামী এখানে পূর্ণ সহযোগিতা করেছেন। এখন নিজের যাতায়াত নিজেই করতে পারি, যখন প্রয়োজন তখন আসা-যাওয়া করতে পারি। এটা খুবই কাজে দিচ্ছে।

গত কয়েক বছরে কল্পনা তঞ্চঙ্গ্যার মতো এরকম আরো প্রায় অর্ধশতাধিক নারী বাইক চালানো শিখেছেন বান্দরবানে। জেলা সদর, রোয়াংছড়ি, রুমাসহ আশপাশের এলাকাগুলোতে এখন হরহামেশাই চোখে পড়ে নারীদের স্বচ্ছন্দ যাতায়াত। পেশাগত এবং পারিবারিক কাজে, কখনোবা স্রেফ দলবেঁধে মজা করার জন্যে তাঁরা দাবড়ে বেড়ান এলাকার অলিগলি, সড়ক-মহসড়ক।

বান্দরবান শহরে কথা হয় বীর বাহাদুর স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষক ড চিং প্রু’র সাথে। তিনি জানান, স্কুলের চাকরিতে যোগ দেবার পর কিছুটা হেঁটে, বাকিটা ইজিবাইকে, তারপর আবার হেঁটে স্কুলে যেতে হতো। কখনো কখনো সময়মতো স্কুলে পৌঁছতে পারতাম না। পাশের বাড়ির এক আন্টিকে দেখেছি বাইকে যাতায়াত করেন। তাঁর কাছ থেকে চালানো শিখলাম। পরে বাবা বাইক কিনে দিলেন। পরিবারের সবাই উৎসাহ দিয়েছে। এমনকি প্রতিবেশীরাও এটাকে বেশ ভালো চোখে দেখেছে। তবে প্রথমদিকে রাস্তায় নামলে বেশ ভয় হতো। ভয় আর সাহস দুইয়ে মিলে ওটাও এক ধরনের আনন্দ ছিলো। এখন বাইক চালানো আমার কাছে খুবই সাধারণ বিষয়।

বাইক চালিয়ে স্বচ্ছন্দে স্কুলে যাতায়াত করেন শিক্ষক ড চিং প্রু

যক্ষ্মা ও কুষ্ঠ নিয়ন্ত্রণ সহকারি হিসেবে স্বাস্থ্য বিভাগে কাজ করেন নি নি প্রু। অফিসের কাজেই তাঁকে পাহাড়ি নানা দূর্গম এলাকায় যাতায়াত করতে হয়। এবং বান্দরবানের নারী বাইকারদের মধ্যে তিনিই সবার আগে চালানো শিখেছেন। এরপর অনেককে শিখিয়েছেন। তিনি বলেন, মেয়েরা এখনো অনেক দিক থেকে পিছিয়ে আছি। যাতায়াত আমাদের জন্যে একটা বড় সমস্যা। বিশেষ করে কর্মজীবি নারীদের জন্যে গণপরিবহনে খুব ভালো পরিবেশ তৈরি হয়নি। মটরবাইক ব্যবহারে আমার সময় বেঁচে যাচ্ছে, খরচ কমেছে, স্বাধীনতাও পাচ্ছি। আমি যখন বাইক চালানো শিখছিলাম, তখন আমার ভাই এটা নিয়ে বেশ সমালোচনা করতো। মেয়েদের বাইক চালানো তখনো এখানে স্বাভাবিক ব্যাপার ছিলোনা। তারপরও প্রয়োজনের তাগিদে শিখেছি, নিয়মিত ব্যবহার করছি। এখন অনেক মেয়েই বাইক চালায়। এখন আর এগুলো দেখতে অস্বাভাবিক লাগেনা।

শিক্ষক ড চিং প্রু বলেন, এখানকার মেয়েরা বিচ্ছিন্নভাবে বাইক চালানোর প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। পরিচিতজনদের সাহায্য নিয়ে অনিয়মিতভাবে এটা হচ্ছে। কার কখন অবসর থাকে, সেভাবে সময় মিলিয়ে অন্যদের কাছ থেকে বাইক চালানো শেখা একটু কঠিন। মেয়েদের জন্যে বান্দরবানে একটা ড্রাইভিং প্রশিক্ষণের প্রতিষ্ঠান থাকলে ভালো হতো। অনেকে আছে, শিখতে চায়। কিন্তু উপযুক্ত ব্যবস্থা না থাকায় আর শেখা হয়না।

বান্দরবান সিভিল সার্জন অফিসে চাকরি করেন হেলেন প্রু। তিনি জানান, বাচ্চাদের স্কুলে আনানেওয়া থেকে শুরু করে বাড়ির বাজার-সদাই, ছোটখাট প্রয়োজনে হুট করে বেরিয়ে পড়া- সবই সম্ভব হচ্ছে বাইক চালাতে পারার কারণে। পরিবারের কোনো কাজে এখন পুরুষ সদস্যদের দিকে তাকিয়ে থাকতে হয়না। নিজেরাই অনেক কাজ করে ফেলা যায়। এতে সন্তান-সন্ততিসহ পুরো পরিবারই সুবিধা পায়।

দৈনন্দিন কাজের ফাঁকে ঘোরাফেরা আর আড্ডাও হয় নারী বাইকারদের। ছবিটি বান্দরবান শহরের নতুন ব্রিজ থেকে তোলা।

বলিপাড়া নারীকল্যাণ সংস্থা (বিএনকেএস)-এর নির্বাহী পরিচালক হ্লা সিং নু। তিনি নিজের প্রতিষ্ঠানের দু’টি প্রকল্পের টাকায় নারীদের জন্যে আলাদা মটরবাইক (স্কুটি) কিনেছেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের সব প্রকল্পে নারীদের আলাদা মটরবাইক দেবার জন্যে দাতাসংস্থাগুলোকে অনুরোধ করা হয়- জানালেন হ্লা সিং নু। তিনি বলেন, আমি নিজে বাইক চালানোর পর উপলব্ধি করেছি নারীদের জন্যে এটা কতোটা স্বাধীনতা এবং স্বাচ্ছন্দ্য এনে দিতে পারে। পরিবারের পুরুষ সদস্যদের ব্যক্তিগত ব্যস্ততা, ইচ্ছা-অনিচ্ছার ব্যাপার থাকে। তাই কোথাও যাওয়া-আসা করতে চাইলে সবসময় তাঁদের সহযোগিতা পাওয়া সম্ভব হয়না।

মটরবাইকে চলাচলের অভিজ্ঞতা সবসময় খুব একটা সুখকর ছিলোনা উল্লেখ করে তিনি বলেন, একদিন এক পুরুষ বাইকার আমার বাইককে পেছন থেকে ধাক্কা দিলো। আমি রাস্তায় পড়ে গেলাম। পাশ থেকে এক বয়ষ্ক ভদ্রলোক বললেন, কি যুগ এলো, মেয়েরাও এখন মটরসাইকেল চালাচ্ছে। আবার একদিন বাড়ি থেকে বেরুচ্ছি। বাজারে তরিতরকারি বিক্রি করতে এসেছেন এক বৃদ্ধা। তিনি আমার কাঁধে হাত রেখে বললেন, ইস্, তোমাদের মতো যদি হতে পারতাম। যখন মাঠপর্যায়ে কাজ করতে যাই, বিশেষ করে গ্রামের মানুষেরা নারীদের এই বাইক চালানোকে খুব উৎসাহ দেয়। নিজেদের সামর্থ না থাকলেও তারা এর প্রয়োজন এবং উপযোগিতা বোঝে। ধীরে ধীরে সমাজের মানুষের মানসিকতায় পরিবর্তন আসছে। আগে অনেকে সমালোচনা করলেও এখন তারা বুঝতে পারছে। যাতায়াতের স্বাধীনতা নারী ক্ষমতায়নের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ।

ফুটবলার নু হাই থুই। তাঁর স্ত্রী কাজ করেন কমিউনিটি হেলথ ওয়ার্কার হিসেবে। তাঁরা পারিবারিক সিদ্ধান্তে একটি স্কুটার কিনেছেন। নু হাই থুই বলেন, পরিবারের পুরুষ সদস্যদের দৃষ্টিভঙ্গি এক্ষেত্রে একটি বড় ব্যাপার। পারিবারিক সহযোগিতা পেলে নারীরা যাতায়াতের এই মাধ্যমটি আরো কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারবেন। তাঁর স্ত্রী বাইক চালাতে পারায় অফিসে আসা-যাওয়া, ফিল্ডে যাওয়া, বাচ্চাদের বেড়াতে নিয়ে যাওয়াসহ সব কাজে পুরো পরিবারই উপকৃত হয়। এক্ষেত্রে নারীদেরকে সাহস যোগানো উচিত। এখন যুগ পাল্টেছে। নারী-পুরুষ সবারই সবকিছুতে অংশগ্রহণ থাকা উচিত।

বান্দরবান ট্রাফিক বিভাগের সার্জেন্ট সালাউদ্দিন মামুন জানান, বান্দরবান বেশ ছোট একটা শহর। এখানে সমতল জায়গা খুবই কম। শহর থেকে একটু বেরুতে গেলেই পাহাড়ি রাস্তা। সেখানে রিক্সা বা ইজিবাইক চলেনা। স্বল্প দূরত্বে চলাচলের জন্যে সিএনজি অটোরিক্সা, জীপ, মাইক্রোবাস ছাড়া আর কোনো পরিবহণ নেই। যে কারণে পাহাড়ি এই শহরে মটরবাইকের কোনো বিকল্প হয়না। পুরুষরা বাইকে চড়ে সব কাজকর্ম সারলেও নারীদের যাতায়াতে ভোগান্তি অনেক বেশি। এখন অনেক নারী সাহস করে বাইক ব্যবহার শিখছেন। এটা একটা ইতিবাচক পরিবর্তন। বান্দরবান ট্রাফিক বিভাগ থেকে নারীদের ড্রাইভিং লাইসেন্স পাবার ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সব সহযোগিতা দেওয়া হয় বলে জানালেন তিনি।

বাইক চালানো শেখা, একত্রে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ানো- এসব করতে গিয়ে বান্দরবানে বিভিন্ন বয়সী নারীদের একটা দল তৈরি হয়েছে। এখনো কোনো প্রাতিষ্ঠানিক নাম বা কাঠামো না থাকলেও এটা এক ধরনের নেটওয়ার্ক। বললেন হ্লা সিং নু। এতে নারীরা তাঁদের পারিবারিক ও সামাজিক নানা বিষয়ে নিজেদের সুবিধা-অসুবিধাগুলো নিয়ে আলোচনা করার একটা সুযোগ পান। তাঁদের সাহস ও আত্মবিশ্বাস বাড়ে। নিজেদের মধ্যে নিয়মিত যোগাযোগ থাকায় একে অন্যের সাহায্যেও দ্রুত এগিয়ে যেতে পারেন। শুধু মটরবাইক নয়, চার চাকার গাড়ি চালানো শিখতেও নারীদের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন উন্নয়ন সংস্থার এই কর্মকর্তা।

বান্দরবান শহরের একটি ক্যাফেতে নারী বাইকারদের আড্ডা

বান্দরবানে ২০১৬ সাল থেকে নারীদের মটরবাইক ব্যবহার বাড়তে শুরু করেছে। সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ, শিক্ষা বিভাগ, কৃষি বিভাগসহ বেসরকারি খাতের নারী কর্মীরা বাইক ব্যবহার করছেন বেশি। বর্তমানে পুরো জেলায় প্রায় ৮০ জনের মতো নারী বাইকার আছেন। ধর্মীয় এবং সামাজিক রক্ষণশীলতা কিছুটা কম হওয়ায় পাহাড়িরা এক্ষেত্রে বাঙালিদের চেয়ে এগিয়ে।

শেয়ার করুন