পাচার হওয়া অর্থে আসছে অস্ত্র, যাচ্ছে জঙ্গিদের হাতে

প্রতিদিন দেশ থেকে কোটি কোটি টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। অর্থ লেনদেনের অবৈধ মাধ্যম ‘হুন্ডি’র মাধ্যমে এ অর্থ পাচার হচ্ছে। আর পাচার হওয়া টাকায় কেনা অস্ত্র ও বিস্ফোরক দ্রব্য দেশে আসছে চোরাপথে। আবার এসব অস্ত্রশস্ত্র জঙ্গিগোষ্ঠীর হাতে চলে যাচ্ছে। এ কাজে এক শ্রেণীর চোরাকারবারী লিপ্ত বলে গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে আশঙ্কা করা হয়েছে। একটি বিশেষ সংস্থার গোয়েন্দা প্রতিবেদনের ভিত্তিতে এ আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের যুগ্ম-সচিব ফরিদ আহাম্মদ। সম্প্রতি দেয়া ওই চিঠির সঙ্গে ২৯ পাতার প্রতিবেদনটিও সংযুক্ত করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের নির্ভরযোগ্য সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। এছাড়া সংশ্লিষ্ট গোয়েন্দা প্রতিবেদনটিও আমাদের হাতে এসেছে।

প্রতিবেদনটির ভিত্তিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মল্লিকা খাতুন স্বাক্ষরিত চিঠি পুলিশ সদর দফতরে দেয়া হয়েছে। প্রতিবেদন ও চিঠি পাওয়ার পর পুলিশ প্রশাসন নড়েচড়ে বসেছে। এ বিষয়ে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা নিতে বৃহস্পতিবার সারা দেশে পুলিশের সব ইউনিটে চিঠি পাঠিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে- সম্প্রতি কিছু রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও পুলিশ সদস্য সিন্ডিকেট করে এজেন্ট ও সাব-এজেন্টের মাধ্যমে টাকা ও বিদেশি মুদ্রা ভারতসহ বিভিন্ন দেশে পাচার করছে। এক্ষেত্রে স্থলবন্দর ও সীমান্তের চেকপোস্ট ব্যবহার করা হচ্ছে। এর সঙ্গে সীমান্তবর্তী এলাকাসহ কিছু এলাকার বাণিজ্যিক ব্যাংক, কুরিয়ার সার্ভিস, সিএন্ডএফ এজেন্ট এবং ইমিগ্রেশনের এক শ্রেণীর কর্মকর্তা-কর্মচারী জড়িত।

প্রতিবেদনে বলা হয়- পাচার হওয়া অর্থের একটি বড় অংশের বিনিময়ে দেশে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক ও মাদকসহ নানা নিষিদ্ধ দ্রব্য আসছে। আবার এসব অস্ত্র ও বিস্ফোরক বিভিন্ন হাত ঘুরে শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ জঙ্গি ও অপরাধীদের হাতে চলে যায়। এসব অস্ত্র জঙ্গিদের হাতে চলে যাওয়ায় দেশের সার্বিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মধ্যে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে। এতে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হচ্ছে। এতে ব্যক্তি, পরিবার ও সমাজে শান্তি-শৃঙ্খলা বিনষ্ট হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, নানা পদ্ধতিতে হুন্ডির মাধ্যমে দেশ থেকে অর্থ পাচার হচ্ছে। আমদানি-রফতানির ক্ষেত্রে এলসি খোলা ও বিদেশ থেকে টাকা পাঠানোর ক্ষেত্রে কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এ কারণে হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ লেনদেন করা হচ্ছে। এক্ষেত্রে টাকার মালিক ও হুন্ডি ব্যবসায়ীদের মধ্যে গোপন সিন্ডিকেট তৈরি করা হয়। চোরাকারবারীরা সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া এবং সৌদি আরবসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থান করে অস্ত্র, বিস্ফোরকসহ নানা পণ্য কিনতে সেসব দেশে থাকা বাংলাদেশি নাগরিকদের কাছ থেকে বিদেশি মুদ্রা সংগ্রহ করে। এরপর ওই মুদ্রা সমপরিমাণ টাকা বাংলাদেশে থাকা তাদের (চোরাকারবারী) এজেন্টদের মাধ্যমে প্রবাসী স্বজনদের পরিশোধ করে। এতে সরকার রেমিটেন্সবঞ্চিত হয়। চোরাচালানি পণ্যগুলোর মূল্য পরিশোধের জন্য চোরাকারবারীরা বাংলাদেশে অবস্থানকারী হুন্ডি ব্যবসায়ীদের টাকা দেয়। ওই টাকার সঙ্গে সাঙ্কেতিক চিহ্ন বা চিরকুট থাকে। ওই সাঙ্কেতিক চিহ্ন বা চিরকুট নিয়ে ভারতসহ বিভিন্ন দেশে অবস্থানকারী ওই সব দেশের হুন্ডি ব্যবসায়ীদের কাছে গেলে তারা তাৎক্ষণিক টাকা পরিশোধ করে। এতে চোরাকারবারীরা দ্রুত অর্থ প্রাপ্তির নিশ্চয়তা পায়।

প্রতিবেদনে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ভারতে অভিবাসী হওয়ার প্রবণতার কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া তারা অর্জিত আয় ও ভূ-সম্পত্তি বিক্রির টাকা ভারতে সঞ্চয় করতে বেশি নিরাপদ বোধ করে। এ ধরনের অর্থের বেশিরভাগই আবার হুন্ডির মাধ্যমে পাচার হয়ে থাকে।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মন্তব্যে বলা হয়- হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাচার অপেক্ষাকৃত সহজ হওয়ায় এটি এখন অর্থ পাচারের প্রধান মাধ্যম হয়ে উঠেছে। আমদানি বা রফতানির মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে বিভিন্ন ধরনের ডকুমেন্ট দেখাতে হয়। এতে অপরাধীর পরিচয় সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়। হুন্ডিতে এজেন্টের মাধ্যমে টাকা লেনদেন হওয়ায় এর অনুঘটকরা থাকে পর্দার আড়ালে। কাগজপত্র ছাড়া লেনদেন হওয়ায় এ প্রক্রিয়ায় পাচারকারীদের শনাক্ত করা কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া হুন্ডির মাধ্যমে টাকা হস্তান্তরে খরচ কম হয়। তাই পাচারকারীদের প্রথম পছন্দ এটি। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, দেশে রেমিটেন্স প্রবাহে হুন্ডি বিরূপ প্রভাব ফেলেছে। কারণ বিদেশ থেকে পাঠানো অর্থের একটি বড় অংশ আসছে হুন্ডির মাধ্যমে। আর রেমিটেন্স আয়ের এ অংশটি হুন্ডির মাধ্যমে আসায় তা বিদেশে পাচারের ক্ষেত্র তৈরি হয়েছে। প্রতিদিনই দেশের পুঁজি গোপনে বিদেশে চলে যাচ্ছে। তাই বৃহত্তর স্বার্থে হুন্ডি বন্ধ করতে হবে।দ

প্রতিবেদনের সুপারিশে বলা হয়, সীমান্তবর্তী এলাকায় র‌্যাব-বিজিবি ও স্থানীয় প্রশাসনের সমন্বয়ে টাস্কফোর্স গঠন করে হুন্ডি চক্রের বিরুদ্ধে অভিযান চালানো যেতে পারে। স্থলবন্দরে ইমিগ্রেশন ও কাস্টমসের সক্রিয়তা বাড়াতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। বিভিন্ন দেশ থেকে বৈধ চ্যানেলে কম খরচে দ্রুত টাকা পাঠানোর নিশ্চয়তা বিধান করা যেতে পারে। হুন্ডির মাধ্যমে টাকা বা বৈদেশিক মুদ্রা পাচারে সহায়তাকারী সন্দেহজনক সিএন্ডএফ এজেন্টদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম নজরদারির পাশাপাশি তাদের মোবাইল মনিটরিং করা যেতে পারে। গোটা বিষয়টি নিয়ে প্রশাসনের পক্ষ থেকে জনসচেতনতা বৃদ্ধি ও প্রচারণা ব্যবস্থা গ্রহণ করা যেতে পারে।

এ ব্যাপারে জানতে বৃহস্পতিবার একাধিকবার আইজিপির দফতরে যাওয়া হলেও তাকে পাওয়া যায়নি। মোবাইল ফোনেও তার সাড়া মেলেনি। তবে পুলিশ সদর দফতরের এআইজি সহেলী ফেরদৌস বলেন, হুন্ডি চক্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রণালয় থেকে যে নির্দেশনা এসেছে সে অনুয়ায়ী আইনগত ব্যবস্থা নেয়ার প্রক্রিয়া অব্যাহত আছে।

শেয়ার করুন