নিরাপদ সড়কের দাবিসহ ৯ দফা বাস্তবায়নে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সহিংসতা, ভাংচুর ও গুজব ছড়ানোর অভিযোগে এ পর্যন্ত রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ৫১টি মামলা হয়েছে।
এর মধ্যে দণ্ডবিধি, বিশেষ ক্ষমতা আইন এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিভিন্ন মামলায় মোট ৯৭ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আরও চার হাজার অভিযুক্তের ব্যাপারে অনুসন্ধান করছেন গোয়েন্দারা। উপযুক্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে নিশ্চিত হওয়া গেলে তাদেরও গ্রেফতার করা হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উসকানিমূলক বক্তব্য দেওয়ার অভিযোগে সর্বশেষ মঙ্গল ও বুধবার কামরাঙ্গীরচর থেকে দুই শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। তারা হলেন- বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ইউল্যাবের ছাত্র নাজমুস সাকিব (২৪) ও কামরাঙ্গীরচরের জামিয়া নুরানিয়া মাদ্রাসার ছাত্র আহমাদ হোসাইন (১৯)।
ইতিমধ্যে গত ৮ আগস্ট রাতে বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এক হাজার পুলিশ সদস্য নিয়ে ‘ব্লক রেইড’ দেয় ঢাকা মহানগর পুলিশ। যদিও এ অভিযানে কেউ গ্রেফতার হয়নি। রাজধানীর যে কোনো এলাকায় আবারও এ ধরনের ব্লক রেইড হতে পারে।
ইতিমধ্যে স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীরা ঘরে ও ক্লাসে ফিরে গেছে। তবে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা রয়েছেন আতঙ্কে। কারণ মামলার এজাহারে শত শত ব্যক্তিকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। তাই যে কোনো সময় গ্রেফতার করে তাদেরও অভিযুক্ত হিসেবে আদালতে হাজির করতে পারবে পুলিশ।
এদিকে নর্থ সাউথ, সাউথইস্ট, ব্র্যাক ও ইস্ট ওয়েস্টের গ্রেফতার ২২ শিক্ষার্থীকে এক দফা রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। বর্তমানে তারা কারাগারে। ঈদের আগে তারা জামিন পাবেন কি-না, তাও জানেন না পরিবারসহ সংশ্নিষ্টরা।
এদিকে, গুজব ছড়ানোর ঘটনায় গ্রেফতার তিন অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট বৃহস্পতিবার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। তারা হলেন- তারেক জিয়া সাইবার পোস্টের মডারেটর ওয়ালিউল্লাহ, মাহবুব তনয় ও আলমগীর। মাহবুব তনয় স্বীকার করেন- এক বড় ভাইয়ের নির্দেশে তিনি অনলাইনে তিনজনের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়েছেন। দুই হাজার লোক জড়ো করার পরিকল্পনা ছিল তাদের।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের ডিসি (মিডিয়া) মাসুদুর রহমান বলেন, আন্দোলনে সহিংসতা, পুলিশের গাড়ি ভাংচুর ও গুজব ছড়ানোর ঘটনায় এ পর্যন্ত গ্রেফতারদের কেউ স্কুলের শিক্ষার্থী নয়। তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার লোক।
পুলিশের সাইবার ক্রাইম বিভাগের ডিসি আলিমুজ্জামান এ ব্যাপারে বলেন, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা গুজব ছড়াতে মূল ভূমিকা রেখেছিল, তাদের শনাক্ত করতে আরও কিছুদিন সময় লাগবে। সাদেক খান নামে একজন সৌদি আরব থেকে তার পেজে আন্দোলন সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়িয়েছে। গ্রেফতার কেউ কেউ জানিয়েছে, তারা অন্যদের কাছ থেকে নির্দেশনা পেয়ে গুজব ছড়িয়েছিল।
শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে সহিংসতার অভিযোগে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্রেফতার ২২ ছাত্রের মধ্যে রয়েছেন রিসালাতুল ফেরদৌস, রেদোয়ান আহমেদ, রাশেদুল ইসলাম, বায়েজিদ, মুশফিকুর রহিম, ইফতেখার আহাম্মেদ, রেজা রিফাত আখলাক, এএইচএম খালিদ রেজা, তারিকুল ইসলাম, নূর মোহাম্মদ, সীমান্ত সরকার, ইকতিদার হোসাইন অয়ন, জাহিদুল হক ও মো. হাসান। তাদের বিরুদ্ধে বাড্ডা থানায় মামলা হয়েছে। এ মামলায় অজ্ঞাত আরও ২০০-২৫০ জনকে আসামি করা হয়েছে।
এ মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বাড্ডা থানার এসআই জুলহাস মিয়া বলেন, এই ১৪ জন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীকে গ্রেফতার করার কারণ, তারা পুলিশের গাড়ি ভাংচুর করছিল। তাদের হাতেনাতে ধরা হয়। রিমান্ড শেষে তারা এখন জেলে। অজ্ঞাত আসামিদের ব্যাপারে তথ্য নেওয়া হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের আন্দোলনে ভাংচুর ও সহিংসতার ঘটনায় ভাটারা থানায় একটি মামলায় ১২ শিক্ষার্থীকে আসামি করা হয়েছে।
গ্রেফতার সাউথইস্ট ইউনিভার্সিটির বিবিএর ছাত্র ইকতিদার হোসাইন অয়নের বাবা এবাদত হোসেন তালুকদার জানিয়েছেন, ৬ আগস্ট বনানীর ক্যাম্পাস থেকে বের হওয়ার পর অয়ন ও তার বন্ধু সীমান্তসহ কয়েকজনকে গ্রেফতার করা হয়। ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে ভাংচুরের ঘটনায় করা মামলায় বাড্ডা থানা পুলিশ গ্রেফতার করে তাদের। যদিও তারা ঘটনার দিন বাড্ডা এলাকায়ই যায়নি।
সীমান্ত সরকারের মা সঞ্চিতা সাহা বলেন, ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত হোক। এতে তার ছেলে অপরাধী হলে দায় মেনে নেবেন তিনি। তবে তার ছেলে অপরাধ করেনি বলেই বিশ্বাস করেন তিনি।
এ মামলায় বৃহস্পতিবার আদালতে জামিনের শুনানি রয়েছে। এ ধরনের বিভিন্ন মামলাজনিত কারণে অন্যান্য শিক্ষার্থী ও তাদের পরিবারের সদস্যরাও আতঙ্কে রয়েছেন।
গ্রেফতার আরও অন্তত দুই শিক্ষার্থীর পরিবারের অভিযোগ, পুলিশ শিক্ষার্থীদের গ্রেফতার করলেও আইনিভাবে তা মোকাবেলায় বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কোনো সহযোগিতা করছে না।
গত ৮ আগস্ট বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের সঙ্গে শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদের বৈঠক হয়। সেখানে উপাচার্যদের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের মামলা প্রত্যাহার করে নেওয়ার অনুরোধ জানানো হয়। শিক্ষামন্ত্রী এ অনুরোধের প্রতিক্রিয়ায় জানান, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা পরিণত। তাদের ক্ষমা করার সুযোগ নেই।
ঢাকা মহানগর পুলিশের দায়িত্বশীল সূত্র জানায়, আন্দোলনে সহিংসতা, গুজব ও ভাংচুরের ঘটনায় দণ্ডবিধি ও বিশেষ ক্ষমতা আইনে দায়ের করা মোট ৪৩ মামলায় ৮১ জনকে এরই মধ্যে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। আন্দোলনে সহিংস ঘটনা ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে উস্কানির পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের রমনা বিভাগে ১৪টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ৩১ জন। রমনা বিভাগে মামলার মধ্যে অজ্ঞাতনামা আসামি রয়েছে ১০ মামলায়। এসব মামলায় গ্রেফতার হয়েছে ২০ জন। এ ছাড়া ৮৪ জনকে আসামি করে দায়ের চারটি মামলায় আসামি করা হয় ১১ জনকে। ১৪টি মামলার মধ্যে ১৩টির তদন্ত করছে থানা পুলিশ এবং একটি মামলা তদন্ত করছে ডিবি পুলিশ।
লালবাগ বিভাগে একটি মামলা হয়েছে অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনকে আসামি করে। একজন গ্রেফতারও হয়েছে। ওয়ারী বিভাগে দুই মামলায় আসামি অজ্ঞাতনামা ৩৫০-৪৫০ জন; গ্রেফতার হয়েছে একজন। এ বিষয়ে মতিঝিল বিভাগে ছয়টি মামলা হয়েছে অজ্ঞাতনামাদের আসামি করে। এসব মামলায় ১০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তেজগাঁও বিভাগে ছয়জনকে আসামি করে দুটি মামলা করা হয়েছে। যার মধ্যে দুইজন এজাহারনামীয়সহ সন্দেহভাজন আরও ছয়জন গ্রেফতার হয়েছে। মিরপুর বিভাগের মিরপুর মডেল থানায় বিইউবিটি ইউনিভার্সিটি, কমার্স কলেজসহ অন্যান্য কলেজের অজ্ঞাতনামা ৫০০-৬০০ জন ছাত্র-শিক্ষককে আসামি করে একটি মামলা করা হয়েছে।
এ ছাড়া অজ্ঞাতনামা ৫০-৬০ জনকে আসামি করে কাফরুল থানায় একটি এবং ৯৬ জনকে আসামি করে আরও তিনটিসহ মোট পাঁচটি মামলা করা হয়েছে। গুলশান বিভাগে অজ্ঞাতনামা ২০০০-২৪৫০ জনকে আসামি করে সাতটি এবং ৩১ জনকে আসামি করে আরও দুটিসহ নয়টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় ২৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। উত্তরা বিভাগে অজ্ঞাতনামা ১০০-১৫০ জনকে আসামি করে তিনটি এবং ১১৩ জনসহ অজ্ঞাতনামা আসামির বিরুদ্ধে একটিসহ মোট চারটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় তিনজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।
এ ছাড়াও তথ্য ও প্রযুক্তি আইনে ২৯ জনকে আসামি করে আটটি মামলা হয়েছে। এসব মামলার মধ্যে চারটি ডিএমপির সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগ, একটি ডিবি পুলিশ এবং একটি থানা পুলিশ তদন্ত করছে। ৫৭ ধারার মামলায় আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, অভিনেত্রী কাজী নওশাবা আহমেদ, বুয়েটের ছাত্র দাইয়ান আলম, জুম-বাংলার প্রধান নির্বাহী ইউসুফ চৌধুরীসহ ১৬ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে।