বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় সম্মেলনের সময় ঘনিয়ে এসেছে। আগামী ২০-২১ ডিসেম্বর রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে অনুষ্ঠিত হবে এ সম্মেলন। এবারের জাতীয় সম্মেলনে দলটির নেতৃত্বে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। সাম্প্রতিক শুদ্ধি অভিযান ও সহযোগী সংগঠনগুলোর সম্মেলনের প্রেক্ষিতে এমন ধারণা করছেন পর্যবেক্ষকরা। সেই সাথে দলটির একাধিক সূত্রও এমন আভাস দিয়েছেন।
জানা গেছে, এবারের জাতীয় সম্মেলনেও কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদকের পদই আলোচনায়। এরই মধ্যে দলের ভেতর ‘সম্পাদক পরিবর্তন হচ্ছেন’ বলে গুঞ্জন ছড়িয়েছে। একই সাথে ওই পদে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরই বহাল থাকছেন বলেও আলোচনা হচ্ছে। তবে এবার দলের কেন্দ্রীয় কমিটিতে যে ব্যাপক রদবদল আসছে, এটা একরকম নিশ্চিত বলে এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে দৈনিক জাগরণ।
সাধারণ সম্পাদক পদে এখন আলোচনায় এসেছে দলটির শীর্ষ পর্যায়ের বেশ কয়েকজনের নাম। তবে এ পদটিতে কি আদৌ পরিবর্তন আসছে, না কি বর্তমান সাধারণ সম্পাদকই বহাল থাকছেন, তা নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে বলেও জানানো হয় এ প্রতিবেদনে।
আওয়ামী লীগ সূত্রের বরাতে প্রতিবেদনে আরো জানানো হয়, এরইমধ্যে সম্মেলনের মাধ্যমে কৃষক লীগ, শ্রমিক লীগ, স্বেচ্ছাসেবক লীগ ও যুবলীগে শীর্ষ নেতৃত্বে আমূল পরিবর্তন এনেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এটা আসলে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির জন্যও একটা ইঙ্গিত। এর আগে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বঞ্চিত হন ৫০ জন এমপি। আর সংরক্ষিত মহিলা আসনের ৪৩ জনের মধ্যে টিকেন মাত্র ২ জন।
আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের নেতারা জানিয়েছে, দলের শীর্ষ পর্যায় থেকে দীর্ঘদিন ধরেই দলে তারুণ্যকে প্রাধান্য দিচ্ছে। যা দেখে দলের শীর্ষ নেতৃত্বেও এবারের পর পরিবর্তন আসতে পারে বলে মনে হতে পারে। হয়তো এ চিন্তা থেকেই দলের শীর্ষ নেতৃত্বের পরিবর্তনের প্রাক-প্রস্তুতি হিসেবে এবার ব্যাপক পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় কমিটিতে।
সূত্র জানায়, এবার দলের কেন্দ্রীয় কমিটি থেকে অনেক ‘প্রভাবশালী’ ও ‘হেভিওয়েট’ নেতা হিসেবে পরিচিতরা বাদ পড়ছেন। যার সংখ্যা দলটির কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের মোট সংখ্যার অর্ধেক। নতুন নেতৃত্বে কারা আসবেন তা নিয়ে দলের নবীন-প্রবীণ নেতাদের কর্মকাণ্ডের বিশ্লেষণ চলছে। তবে দলের কেন্দ্রীয় কমিটি ৮১ সদস্যেরই থাকছে।
এখনো দলের কোনো কেন্দ্রীয় নেতাই বলতে পারছেন না আওয়ামী লীগের দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ পদে কে শেষ পর্যন্ত আসছেন। সম্মেলনে তরুণ নেতৃত্বকে এবার গুরুত্ব দেয়ার পাশাপাশি যারা স্বচ্ছ ভাবমূর্তির ও অতীতে দলের জন্য ত্যাগ স্বীকার করেও এখনো তেমন কিছুই পাননি তারা অগ্রাধিকার পাচ্ছেন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের বর্তমান কমিটিতেই একটি সদস্য ও সভাপতিমণ্ডলীর দুটি সদস্য পদ খালি আছে। সেগুলো এই মুহূর্তে পূরণ হবে না। সম্মেলনের পর সেগুলো পূরণ করা হবে।
অন্য একটি সূত্র জানায়, দলের সাধারণ সম্পাদক ও গুরুত্বপূর্ণ পদে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে যাচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কেন্দ্রীয় কমিটির অনেকের পদোন্নতি ও অনেকের পদাবনতি হতে যাচ্ছে। গত কয়েক বছরে দলের কোনো কাজেই যাদের দেখা যায়নি, এমন নেতারা বাদ পড়তে যাচ্ছেন। এ ছাড়া সারা দেশে দলের তৃণমূল থেকে আওয়ামী লীগের কর্মঠ, ত্যাগী ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তির কয়েকজন নেতাকে পুরস্কৃত করা হবে। নতুন ও তরুণ নেতৃত্বের জন্য সাবেক কয়েকজন ছাত্রলীগ নেতাও মূল দলের নেতৃত্বে আসতে যাচ্ছেন।
সম্পাদকমণ্ডলীর অনেক সদস্য এখন মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়েছেন, আগামী সম্মেলনে সেখানে কি নতুন মুখ দেখা যাবে এ বিষয়ে প্রশ্ন করলে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘এটা ডিসাইড করার মালিক আমাদের সভাপতি, এটা আমাদের গঠনতন্ত্রে ক্ষমতা দেয়া আছে। আমাদের নেত্রী, বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা, তিনি নির্ধারণ করবেন কে আসবে দলে। আমাদের দলে শেখ হাসিনা ছাড়া আরও কেউ অপরিহার্য ব্যক্তি নয়। আমি আপনাদের পরিষ্কারভাবে বলতে চাই, আমরা কেউই অপরিহার্য নই।’
আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গেছে, দলের মধ্যে চলমান শুদ্ধি অভিযানের প্রভাব পড়বে দলের কেন্দ্রীয় সম্মেলনেও। যারা এরইমধ্যে বিতর্কিত, তারা কমিটিতে স্থান পাবেন না। নতুন-পুরনো মিলেই কমিটি হবে। সভাপতিমণ্ডলী থেকে কেউ উপদেষ্টাও হতে পারেন। আবার উপদেষ্টা থেকে সভাপতিমণ্ডলী, যুগ্ম সম্পাদক পদ থেকে সদস্য কিংবা সদস্য থেকে যুগ্ম সম্পাদকও হতে পারেন। কমিটি থেকে বাদও পড়তে পারেন অনেকে। আসতে পারে নতুন মুখ।
দলের সাধারণ সম্পাদক পদ প্রসঙ্গে ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘দলের সাধারণ সম্পাদক পদেও নেত্রী না ইচ্ছা করবেন, সেটাই হবে। তিনি পরিবর্তন চাইলে, পরিবর্তন হবে। আমাদের এখানে কোনো প্রতিযোগিতা নেই। হয়তো কারও কারও ইচ্ছা, আকাঙ্ক্ষা থাকতে পারে। সাধারণ সম্পাদক পদেও প্রার্থী থাকতে পারে। সেখানে কোনো অসুবিধা নেই। আমি যদি মনে করি আমার প্রতিদ্বন্দ্বী আর কেউ হতে পারবে না, এটা তো ঠিক না। এটা ডিসাইড করবেন নেত্রী, তবে প্রার্থী হওয়ার অধিকার সবার আছে।’
দলের সাধারণ সম্পাদক পদ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের এক কেন্দ্রীয় নেতা বলেন, ‘অতীতে দলে অনেক কেন্দ্রীয় ও বড় নেতা ছিল। যাদের সারা দেশের প্রতিটি অলিতে-গলিতে চিনতো। যাদের দলের তৃণমূল পর্যায় পর্যন্ত কার্যকর গ্রহণযোগ্যতা ছিল। সারা দেশের তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের যিনি আন্দোলিত করতে পারেন। বর্তমানেও যিনি সাধারণ সম্পাদক তারও তৃণমূল পর্যায়ে ব্যাপক নেতাকর্মী ও সমর্থক রয়েছে। দলের সাধারণ সম্পাদক পদে এমনই একজন আসবেন। তবে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।’
দলের সভাপতিমণ্ডলীর একজন সদস্য বলেন, ‘দলের তৃণমূল ও জনগণের প্রত্যাশা ছাড়াও দল ও রাজনীতির জন্য যিনি সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য হবেন তাকেই আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচন করা হবে। এখানে যোগ্যতাই একমাত্র মাপকাঠি।’
দলীয় সূত্রগুলো বলছে, দলের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে ওবায়দুল কাদেরই বহাল থাকার সম্ভাবনাই বেশি। কারণ তিনি বেশ কিছুদিন অসুস্থ থাকলেও এখন অনেকটাই সুস্থ রয়েছেন। পুণরায় তার এ পদে থাকার সম্ভাবনা প্রবল।
তবে অপর সূত্রগুলো বলছে ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, এবার দলের সাধারণ সম্পাদক পদে রদবদল প্রায় পাকাপাকি। যার অনেক ইঙ্গিত দলীয় প্রধানের কাছ থেকে তারা পেয়েছেন। নানা দিক থেকে দলের অন্তত ৭ জন এ পদের জন্য আলোচনায় আছেন। এর মধ্যে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ, দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি, জাহাঙ্গীর কবির নানক, দলের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, দলের সাংগঠনিক সম্পাদক ও নৌপ্রতিমন্ত্রী খালিদ মাহমুদ চৌধুরীর নামই ঘুরেফিরে আসছে।
জানা গেছে, দলের সাধারণ সম্পাদক পদে রদবদল হলে তাতে যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক পদে থেকেই আসার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি। এ পদের ৩ জনই আলোচনায় রয়েছেন। এই তিন জনের মধ্যে থেকে যিনি দলের জন্য গত কয়েক বছরে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কর্মঠ ভূমিকায় ছিলেন তার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
সূত্র জানায়, দলীয় মনোনয়ন না পেয়েও গত এক বছর দলের অনেক সাংগঠনিক কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছেন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতা। যারা বর্তমানে দলের সকল কর্মকাণ্ডেই যুক্ত থাকছেন, দলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ হয়ে কাজ করছেন। তারা দলের গুরুত্বপূর্ণ পদই পেতে যাচ্ছেন।
জানা গেছে, আওয়ামী লীগের ১৭ সদস্যবিশিষ্ট সভাপতিমণ্ডলীর সদস্যদের মধ্যে অন্তত ১০ জন বাদ পড়তে যাচ্ছেন। এদের বেশ কয়েকজন সাবেক মন্ত্রী, যারা এবার উপদেষ্টা পরিষদে স্থান পেতে যাচ্ছেন। উপদেষ্টা পরিষদ থেকে ৩ জন সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হতে পারেন বলে দলে আলোচনা রয়েছে। দলের সম্পাদকমণ্ডলীর মধ্যে অনেকেই বিতর্কিত হওয়ায় বাদ পড়তে পারেন। দলে নিষ্ক্রিয়তা, কমিটি বাণিজ্য, নিজ এলাকায় দলীয় কোন্দল নিরসন করতে না পারাই এর মধ্যে অন্যতম কারণ। তবে নানা কারণে আবার কয়েকজন তরুণ নেতা এবার তাদের কাজের জন্যও পুরষ্কৃত হতে যাচ্ছেন। দলের ৮ সাংগঠনিক সম্পাদকের অধিকাংশই এবার বাদ পড়তে পারেন। সম্পাদকমণ্ডলীর আরো কয়েকটি পদে আসতে পারে পরিবর্তন।