বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চলে বসবাসকারী মারমা জনগোষ্ঠীর বর্ষবরণ উৎসব সাংগ্রাই। ধর্মীয় ও সামাজিক নানা আচার-অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রায় সপ্তাহব্যাপী এই উৎসবটি উদযাপন করেন তাঁরা। বহুবিধ অনুষ্ঠানের মধ্যে পরষ্পরের গায়ে পানি বর্ষণের পর্বটি অন্যতম। এই পর্বটিকে কেউ কেউ বলছেন ‘মৈত্রী পানি বর্ষণ’, কেউ বলছেন ‘জলকেলি’ কেউ বলছেন ‘পানি খেলা’। তবে মারমা ভাষার ‘মইত্তা রি লং পোয়ে’ কথাটির যথাযথ বাংলা কোনটি?
এ বিষয়ে খোলা চোখ-এর সাথে আলাপচারিতায় বান্দরবানের লেখক ও গবেষক ক্য শৈ প্রু খোকা বলেন, প্রাচীণ সাহিত্য এবং জীবনাচরণ বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাই, ‘জলকেলি’ মূলতঃ পানিতে নেমে যুবতীদের খেলা। সেখানে কোনো পুরুষ থাকতো না। বরঞ্চ যুবকরা কৌতুহলবশতঃ আড়ালে-আবডালে লুকিয়ে যুবতীদের এই খেলা দেখতো। সেই বিবেচনায়, পাহাড়ের বর্ষবরণ উৎসবের একটি অংশ ‘রি লং পোয়ে’ কিছুতেই ‘জলকেলি’ নয়। তাই আভিধানিক এবং অনুভূতির দৃষ্টিকোণ থেকে ‘মৈত্রী পানি বর্ষণ’ কথাটিকেই আমার কাছে প্রমিত মনে হয়।
দৈনিক প্রথম আলো’র বান্দরবান প্রতিনিধি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক এবং গবেষক বুদ্ধজ্যোতি চাকমার সাথে কথা হয়। গণমাধ্যমে ‘জলকেলি’ শব্দটি ব্যবহারের বিষয়ে তিনি বলেন, পাহাড়ের সংস্কৃতি সম্পর্কে জানাশোনার সীমাবদ্ধতার কারণে এই শব্দটি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার স্থানীয় প্রতিনিধিরা কর্তৃপক্ষের জানার সীমাবদ্ধতাকে ব্যবহার করে এই শব্দটির অপপ্রয়োগ করে থাকেন। বর্ষবরণে পানি বর্ষণের মূল্যবোধ সম্পর্কে জানার চেষ্টা না করে তারা সস্তা রঙচং মাখিয়ে বাজারকাটতি সংবাদ পরিবেশনের উদ্দেশ্যেই এটি করে থাকে। ‘মৈত্রী পানি বর্ষণ’কে ‘জলকেলি’ লেখা পাহাড়ের সংস্কৃতিকে অবমাননার শামিল।
বান্দরবানের কবি ও লেখক, চাগাঃ থিয়েটার আর্টস-এর সভাপতি এবং মঞ্চনাট্যাভিনেতা জলিমং মারমা বলেন, আমরা আসলে যা দৃশ্যমান তা-ই নামকরণ করি। এর গভীরে গিয়ে প্রকৃত অর্থ খোঁজার মানসিকতা অনেকের থাকেনা। মারমা ভাষার ‘মইত্তা’ অর্থ বাংলায় ‘মৈত্রী’। ‘রি লং পোয়ে’ অর্থ ‘পানি বর্ষণ অনুষ্ঠান বা উৎসব’। সুতরাং এটা কিছুতেই ‘জলকেলি’ নয়।
বাংলা একাডেমী প্রণীত ‘ব্যবহারিক বাংলা অভিধান’ অনুযায়ী ‘জলকেলি’ শব্দের অর্থ ‘পানিতে নেমে সন্তরণাদি খেলা; জলবিহার’। আর, পরষ্পরের গায়ে পানি ছুঁড়ে পুরনো বছরের দুঃখ-গ্লানি বিদায় দিয়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর যে উৎসব, পাহাড়ের মারমা জনগোষ্ঠী সেটিকে ‘মৈত্রী পানি বর্ষণ’ হিসেবেই অভিহিত করে থাকে।