“এখনো অঙ্কুর যাহা তারই পথপানে, প্রত্যহ প্রভাতে রবি আশীর্বাদ আনে!” রবি ঠাকুরের এ বাণীর মর্ম যেন নতুন করে উপলব্ধি করা যায় শান্তিনিকেতনের পথে পথে। কলকাতা থেকে ২১২ কিলোমিটার উত্তরে বীরভূম জেলার বোলপুরের কাছে একটি ছোট শহর শান্তিনিকেতন। শহরটি জুড়ে আছে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং তাঁর অসামান্য কর্মকাণ্ড।
সাহিত্য ও সংস্কৃতির এক অসাধারণ মেলবন্ধন নিয়ে শান্তিনিকেতন পরিণত হয়েছে জ্ঞানপিপাসু ও ভ্রমণপিপাসুদের এক তীর্থস্থানে । ১৮৬২ সালে মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর ভ্রমণকালে বিশ্রামের উদেশ্যে এখানে থামেন এবং জায়গাটি তাঁর পছন্দ হয়ে যায়। তখন এই জায়গার নাম ছিল ভুবনডাঙ্গা। এর এক বছর পর তিনি এই আশ্রমটি প্রতিষ্ঠা করেন এবং এর নামকরণ করেন শান্তিনিকেতন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের বেড়ে ওঠা এই শান্তিনিকেতনে। ১৯০১ সালে তিনি এখানে পাঠভবন তৈরি করেন। গতানুগতিক শিক্ষার ধারা থেকে বের করে এক নতুন মাত্রা যোগ করেন তিনি। প্রকৃতির সন্নিবেশে পুঁথিগত বিদ্যার বাইরেও আত্মার সমৃদ্ধির স্ফুরণে নতুন আঙ্গিকে তিনি তাঁর বিদ্যালয়কে এক সময় বিশ্ববিদ্যালয়ে পরিণত করেন। যা এখন বিশ্বভারতী নামে পুরো পৃথিবীজুড়ে সমাদৃত।
শান্তিনিকেতনের আবেশে জড়াতে চাইলে এখানে হেঁটে হেঁটে সময় কাটানো ভাল। হিন্দি ভবন, চীনা ভবন, বিদ্যা ভবন, আনন্দ পাঠশালা, আম্রকুঞ্জ, কালবাড়ি, শ্রীসদন, সঙ্গিতভবন, কলাভবন এসব ভবনই একে একে চোখে পড়বে। ছাতিমতলার ডানদিকের বড় বাড়িটিই শান্তিনিকেতন গৃহ! এখানেই কবিগুরু তাঁর প্রথম লেখা ‘জল পড়ে পাতা নড়ে’ লেখেন। আরও দেখা মিলবে কবির বিভিন্ন সময়ের বাড়ি দেহলি, শালবীথি, উত্তরায়ণ। উত্তরায়ণ-এ ঢুকেই বাঁ দিকে বিচিত্রাভবন বা রবীন্দ্র মিউজিয়াম।
পর্যটনস্থান হিসেবেও শান্তিনিকেতনের রয়েছে অনন্য আবেদন। খোয়াইয়ের ঘাট, ছাতিমতলা, রবীন্দ্র মিউজিয়াম, সোনাঝুরি, আমার কূটির, নন্দন আর্ট গ্যালারি দেখতে রবীন্দ্রপ্রেমী এবং ভ্রমণপ্রেমীদের উৎসাহের সীমা নেই। সেই সাথে শান্তিনিকেতনের আকর্ষণকে আরও বাড়িয়ে তোলে বাউল গান, পৌষমেলা, বসন্ত উৎসব, জয়দেব কেদুলির মেলা, কূটির শিল্প। শান্তিকেতনী বাটিকের পসার বিশ্বজোড়া।
এইসব কিছুকে ছাপিয়ে শান্তিনিকেতনের রাঙ্গা মাটির পথে পথে ছড়িয়ে আছে কবিগুরুর স্মৃতি। যে পথে কবিগুরু হেঁটে গেছেন, যেখানে কেটেছে তাঁর শৈশব, কৈশোর যৌবন, বার্ধক্যের গুরুত্বপূর্ণ সব সময়, কাটিয়েছেন অম্ল-মধুর বেলা, লিখেছেন কালজয়ী সব লেখা, হারিয়েছেন প্রিয়জন, গড়ে তুলেছেন এক অনিন্দ্য বিদ্যাপীঠ! আর এসবের সারথী হয়ে আজও কতো সহস্র কোটি মানুষ ভালোবাসা দিয়ে যাচ্ছে, নিয়ে যাচ্ছে, স্বপ্ন দেখছে, স্বপ্ন দেখাচ্ছে।
লেখক: মাহজাবীন ফেরদৌস