‘যাঁরা গ্যাসের দাম নিয়ে আন্দোলন করছেন, তাঁরা প্রকৃত অবস্থা চিন্তা করছেন না, অথবা উন্নয়নটা দেখতে পাচ্ছেন না। এটা দুঃখজনক। গ্যাসের দাম ৭৫ শতাংশ বাড়ানোর প্রয়োজন ছিল। কিন্তু জনগণের কথা চিন্তা করে তা করা হয়নি। ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে।’
আজ বৃহস্পতিবার জাতীয় সংসদের তৃতীয় অধিবেশনের (বাজেট অধিবেশন) সমাপনী ভাষণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। ধর্ষণের বিচারসংক্রান্ত আইন আরও কঠোর করা প্রয়োজন বলেও মন্তব্য করেন সংসদ নেতা।
এর আগে বিরোধী দলীয় উপনেতা রওশন এরশাদ বলেন, ‘আমরা উন্নয়ন চাই, কিন্তু গ্যাসের দাম বাড়াতে চাই না।’
রওশনের বক্তব্যের প্রসঙ্গ টেনে সংসদ নেতা শেখ হাসিনা বলেন, গ্যাসের দাম নিয়ে যথেষ্ট কথাবার্তা ও আন্দোলন হয়েছে। গ্যাসের দাম বৃদ্ধির জন্য অনেকে সমালোচনা করেছেন, প্রতিবাদ করেছেন।
গ্যাসের দাম বাড়ানোর কারণ ব্যাখ্যা করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। চাহিদা ছিল ৩৭০০ এমএমসিএফটি কিন্তু সরবরাহ করা যাচ্ছিল মাত্রা ২৬০০ এমএমসিএফটি। এই ব্যাপক চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে এলএনজি আমদানির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এর অংশ হিসেবে এক হাজার এমএমসিএফটি এলএনজি গ্যাস আমদানি শুরু হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেশের নিজস্ব প্রাকৃতিক গ্যাস প্রতি ঘন মিটারে উৎপাদন খরচ হয় ৭ দশমিক ৫০ টাকা। এলএনজির খরচ পড়ে ৩৩ দশমিক ৭৫ টাকা। এ জন্য প্রতি বছর ৩০ হাজার কোটি টাকা অতিরিক্ত দিতে হয়।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের ৭৫ শতাংশ মূল্য বৃদ্ধি করার প্রয়োজন ছিল। কিন্তু সেটা করা হয়নি। আমাদের প্রতি ঘনমিটারের এলএনজি আমদানির মূল্য পড়ছে ৬১ দশমিক ১২ টাকা। কিন্তু সেখানে আমরা নিচ্ছি ৯ দশমিক ৮০ টাকা। অর্থাৎ ৫১ দশমিক ৩২ টাকা আর্থিক সহায়তা করা হচ্ছে। ফলে এর জন্য ১৯ হাজার ৩১০ কোটি টাকা ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। এটাও আবার সব ধরনের ট্যাক্স আর শুল্ক বাদ দিয়ে।’
সংসদ নেতা বলেন, গ্রাহকদের আর্থিক চাপ বিবেচনা করে মাত্র ৩২ দশমিক ৮ শতাংশ দাম বাড়ানো হয়েছে। বিভিন্ন শ্রেণির গ্রাহকদের চাহিদা বিবেচনায় মিনিমাম চার্জ প্রত্যাহার করা হয়েছে। গ্যাস ব্যবহারের হিসাব নির্দিষ্ট রাখতে ইবিসি মিটার দেওয়া হবে। এতে বিল পরিশোধ সহজ হবে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘মানুষের কথা চিন্তা করে প্রতিটি ক্ষেত্রে আমরা সহনশীল পর্যায়ে রাখার চেষ্টা করেছি। আমরা সরকারিভাবে আর্থিক সহায়তা করছি। সরকারের পক্ষ থেকে টাকা দিচ্ছি। আবার জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকেও দেওয়া হচ্ছে। গ্রাহকদের আর্থিক চাপ যাতে বেশি না পড়ে, তার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে প্রতিবছর ৭ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা ভর্তুকি এবং জ্বালানি নিরাপত্তা তহবিল থেকে ২ হাজার ৪২০ কোটি টাকা প্রদান করা হচ্ছে।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এলএনজির সঙ্গে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংমিশ্রণেরও একটা খরচ আছে। মিশ্রিত গ্যাসের মূল্য সহনীয় রাখার জন্য গত বছর সেপ্টেম্বর থেকে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর থেকে ৯৪ শতাংশ সম্পূরক শুল্কের পুরোটাই প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ জন্য সরকারের ৯ হাজার ২০০ কোটি টাকা রাজস্ব আদায় বন্ধ হয়েছে। এই টাকা আদায় করে উন্নয়নের কাজে ব্যয় করা যেত। কিন্তু মানুষের অসুবিধার কথা চিন্তা করে তা করা হয়নি। সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের পরও ২০১৮-১৯ অর্থ বছরে এলএনজি আমদানির কারণে প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা ঘাটতি ছিল, যা ভর্তুকি দিয়েই সরকার পূরণ করেছে।
গত ১০ বছরে সরকার ১ হাজার ২৫০ এমএমসিএফটি গ্যাস নতুন করে জাতীয় পাইপলাইনে যুক্ত করেছে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, চারটি ব্লকে গ্যাস উত্তোলনের জন্য পৃথক চুক্তি হয়েছে। ভোলায় নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার হয়েছে। সেখানে উত্তোলনও শুরু হয়েছে।
গ্যাসের দাম বৃদ্ধির কারণ উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্যাসের চাহিদা মেটানোর জন্য এলএনজি আমদানি করা হচ্ছে। শিল্পায়ন হচ্ছে। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে গ্যাসের চাহিদা বাড়ছে। গ্যাসের জন্য কূপ খনন করা হচ্ছে, পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হচ্ছে। যেটুকু পাওয়া যাচ্ছে তা উত্তোলন করা হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যেটা করছি, তা দেশের সার্বিক উন্নয়নের জন্য। কোনো উন্নয়ন জ্বালানি ছাড়া হয় না। আমরা ৯৩ ভাগ মানুষকে বিদ্যুৎ দিচ্ছি। আমরা ২০২৪ সালের মধ্যে ডাবল ডিজিটে প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে চাই। এ জন্য আমাদের জ্বালানি দরকার। এলএনজি আমদানির কারণে জনজীবনে বাড়তি চাপ যাতে না পড়ে, সে জন্য দেশীয় গ্যাসের সঙ্গে মিশ্রিত করে জাতীয় পাইপলাইনে সরবরাহ করছে। এ ক্ষেত্রে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে প্রতি ঘনমিটারে মাত্র ১২ দশমিক ৬০ টাকা।’
শেখ হাসিনা বলেন, গ্যাস দিতে না পারলে উৎপাদন ও কর্মসংস্থান ব্যাহত হবে। ভর্তুকি দিয়েই এটা আনা হচ্ছে। জনগণের থেকে এই বাড়তি টাকা নেওয়া হচ্ছে না।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের কী করা উচিত? যতটা উৎপাদন বা আনার খরচ হবে পুরোটাই জনগণের থেকে নেওয়া উচিত। কিন্তু সেটা তো আমরা করছি না।’
প্রধানমন্ত্রী বলেন, এলএনজি আমদানি করে বাংলাদেশের গ্যাসের দাম বাড়ানো হলেও পৃথিবীর অন্যান্য দেশের থেকে অনেক কম। যাঁরা বলেছেন ভারত দাম কমিয়েছে, সেটা কিন্তু সঠিক নয়।
গৃহস্থালিতে বাংলাদেশে ১২.৬০ টাকা, ভারতে ৩০.৩৭ রুপি, শিল্পে বাংলাদেশে ১০.৭০, ভারতে ৪০ থেকে ৪২ রুপি। সিএনজি বাংলাদেশে ৪৩ টাকা, ভারতে ৪৪ রুপি আর বাণিজ্যিক বাংলাদেশে ২৩ টাকা এবং ভারতে ৫৮-৬৫ রুপি। তাহলে ভারত কমাল কী করে? প্রতিটি ক্ষেত্রে তো বেশি আর তাদের রুপিতে তো আরও বেশি।
শেখ হাসিনা বলেন, তিনি যুক্তরাষ্ট্রের কাছে গ্যাস বিক্রির মুচলেকা দেননি। যে কারণে ২০০১ সালে বেশি ভোট পেয়েও আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় যেতে পারেনি। জিমি কার্টারের কাছে মুচলেকা দিয়েছিলেন বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
ধর্ষণ ও সামাজিক অপরাধের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হবে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, শিশুদের ওপর অত্যাচার বা কথায় কথায় মানুষ খুন করা, ছোট শিশুদের খুন করার মতো সামাজিক অপরাধ প্রবণতা বেড়ে গেছে। গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে যেন সেটা আরও বেড়ে যায়। তিনি গণমাধ্যমকে ধর্ষণকারীর চেহারা বারবার দেখানোর আহ্বান জানান, যাতে তাদের লজ্জা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমাদের আইনটা আরও কঠোর করা দরকার। এ ধরনের অসামাজিক কার্যকলাপ কখনোই মেনে নেওয়া যায় না।’
ধর্ষণের বিরুদ্ধে পুরুষদেরও সোচ্চার হওয়ার আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, শুধু মেয়েরা প্রতিবাদ করবে কেন? পুরুষ সম্প্রদায়ের জন্য লজ্জার বিষয় যে, পুরুষেরা অপরাধটা করে যাচ্ছে।
সরকারি চাকরিতে কোটা ব্যবস্থা সংস্কারের আন্দোলন চলাকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসভবনে হামলা ও লুটপাটের ঘটনার মামলা আবার সচল করার কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে তিনি বলেন, যারা এ ধরনের ঘটনা ঘটিয়েছে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া দরকার এবং এই মামলাগুলো সচল করে শাস্তি দেওয়া দরকার। ভবিষ্যতে যেন আর কেউ এ রকম করতে না পারে।
প্রধানমন্ত্রী শিক্ষা খাতে এবং উচ্চশিক্ষায় সরকারের ভর্তুকি দেওয়ার চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, শিক্ষা খাতে যত ভর্তুকি দেওয়া হয়, পৃথিবীর আর কোথাও দেওয়া হয় না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক বেতন ৩০ টাকা, হলের সিট ভাড়া ৩০ টাকা, বাস ভাড়া ৯০ টাকা। বুয়েটের মাসিক বেতন ১৫ টাকা। ফেরিওয়ালার কাছ থেকে চা কিনে খেতেও ২০ টাকা লাগে। একইভাবে তিনি রাজশাহী, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে মাসিক বেতন, হলের সিট, বাস ভাড়ার চিত্র এবং তাতে সরকার কত ভর্তুকি দেয়, তার চিত্র তুলে ধরেন। একই সঙ্গে হলের কক্ষে ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি শিক্ষার্থী কষ্ট করে থাকেন বিধায় তাঁদের ধন্যবাদ জানান।