কে করবে দুনিয়া শাসন? ফেসবুক-গুগলের মতো বড় বড় প্রতিষ্ঠান কি আধিপত্য আরও বাড়াবে, নাকি রাষ্ট্র বা সরকার বিশাল দৈত্য হয়ে ওঠা এসব প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে? ফেসবুকের কথাই ধরা যাক। ২০০ কোটি ব্যবহারকারীর এ সাইট একটি দেশের চেয়েও যেন বড় প্ল্যাটফর্ম হয়ে উঠেছে। ফেসবুকের প্রভাব এখন ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ওপর পড়তে দেখা যাচ্ছে। আলোচনা-সমালোচনা চারধারে। গুগল-ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ এখন সময়ের দাবি। কিন্তু কীভাবে?
গুগল-ফেসবুকের মতো প্রতিষ্ঠানে বড় পদ নিশ্চয়ই স্বপ্নের এক চাকরি। খুব বেশি দিন আগের কথা নয়; পশ্চিমা কোনো প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান পদটা লোভনীয় ছিল। কারণ, কোটি কোটি ডলার আর চারপাশে কত প্রশংসা। কিন্তু এখন দিন বদলে গেছে। প্রশংসার বিপরীতে এখন সমালোচনার তিরও সইতে হচ্ছে।
প্রযুক্তি বিশ্বের পরিচিত প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে এখন বড় বড় অভিযোগ। একেকটি প্রতিষ্ঠান হয়ে গেছে একটি দেশের চেয়েও বড়। নীতিনির্ধারকদের নেই কোনো নিয়ন্ত্রণ, প্রতিযোগিতার ধার ধারেন না প্রতিষ্ঠানগুলো। ইকোনমিস্টের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, বড় প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর বিরুদ্ধে একক আধিপত্য ধরে রাখা, মানুষকে আসক্ত করে ফেলা, গণতন্ত্রকে হুমকির মুখে ফেলার মতো কত অভিযোগ এখন! শুধু কি অভিযোগেই শেষ? বিশাল দৈত্যতে পরিণত হওয়া প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ন্ত্রণের কথা উঠতে শুরু করেছে। নিয়ন্ত্রকেরা জরিমানা করছেন। রাজনীতিবিদেরা সমালোচনায় দগ্ধ করছেন। এমনকি একসময় যাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানের পক্ষে উচ্চকণ্ঠে কথা বলেছেন, তাঁরাও মুখ ফিরিয়ে নিয়েছেন। তাঁরা এসব প্রতিষ্ঠানের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে সতর্কবার্তা দিয়েছেন। সম্প্রতি প্রযুক্তি বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে কাজ করা সাবেক কর্মীরা মিলে ‘সেন্টার ফর হিউম্যান টেকনোলজি’ নামের একটি সংস্থা গঠনও করেছেন।
ইকোনমিস্টের সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো নিয়ে এখন নানা বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বড় প্রতিষ্ঠানগুলো মানুষকে ধোঁকা দিচ্ছে, নাকি সেবা দিচ্ছে, সে বিষয়টি স্পষ্ট নয়। বড় প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ফেসবুক, গুগল ও আমাজনকে ঘিরে স্বচ্ছ ও সুষ্ঠু প্রতিযোগিতার বিষয়টি নিয়ে দুশ্চিন্তা তৈরি হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে, তারা প্রায়ই আইনি প্রক্রিয়ায় নানা ছাড় পেয়ে যায়। গুগল ও ফেসবুকে ব্যবহারকারীদের কাজের জন্য জবাবদিহি করতে হয় না। দীর্ঘদিন ধরে আমাজনে মার্কিন ক্রেতাদের বিক্রয়কর দিতে হয় না। এ ছাড়া বড় প্রতিষ্ঠান হিসেবে বাজারে তাদের প্রতিযোগিতার মুখ পড়তে হয় না। এ ছাড়া তারা নিজেরা বাজার হিসেবে কাজ করছে। অবকাঠামো বা প্ল্যাটফর্ম হিসেবে ডিজিটাল অর্থনীতি গড়ে তুলেছে। তাদের অধিকাংশ সেবা দৃশ্যত বিনা মূল্যে। কিন্তু এর বিনিময়ে ব্যবহারকারীদের মূল্যবান তথ্য নিচ্ছে তারা।
প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলো ভোক্তাস্বার্থ উপেক্ষা করে নিজেদের সুরক্ষা ও বাজারে আধিপত্য ধরে রাখতে তাদের ক্ষমতা ব্যবহার করবে—এমন আশঙ্কার কথা উঠে আসছে। ভোক্তাস্বার্থ রক্ষায় এসব প্রতিষ্ঠানকে বশে রাখতে নীতিনির্ধারকের কতটা সফল হবেন, সে প্রশ্নও এখন উঠছে।
তবে সরাসরি এসব প্রতিষ্ঠানকে ধরার উপায় নেই। তারা যে ক্রেতার ক্ষতি করছে, তা প্রমাণ করতে পারা কঠিন। কারণ, তারা বলছে, ক্রেতাকে বিনা মূল্য সেবা দিচ্ছে তারা। উদ্যোক্তা প্রতিষ্ঠানগুলো উঠে এসে এসব বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারবে না। অর্থের জোরে ভালো ধারণাগুলো কিনে নেবে তারা। যেকোনো উপায়ে মুনাফা ওই বড় প্রতিষ্ঠানের পকেটেই যাবে। এর প্রাথমিক সংকেত কিন্তু ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে।
এদের ঠেকাতে কী করা যায়? অবশ্য বর্তমানে দাম নিয়ন্ত্রণ ও মুনাফার ওপর বাঁধ দেওয়া কঠিন। কারণ, এসব প্রতিষ্ঠান দাবি করে বিনা মূল্যের সেবা দেয়। এর সঙ্গে উদ্ভাবন ও বিনিয়োগে স্বার্থ যুক্ত। তাই ভেঙে দিলে তা গ্রাহকসেবার ওপর প্রভাব পড়তে পারে। সাধারণ সমাধানের পথ খোলা নেই। তাই নীতিনির্ধারকদের গভীরভাবে ভাবতে হবে। বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক যে আইন আছে, তার সদ্ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি প্রযুক্তিবাজার নিয়ে নতুন করে ভাবার সময় এসে গেছে।