গিয়েছিলাম পাহাড়ে, আহারে!

গুগলে ছবি দেখে দেখে স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতে পৌঁছে গেলাম পাহাড়ি কন্যা বান্দরবানে। প্রথম দিন খুব সকালে গেলাম মধ্যমপাড়া মারমা বাজারে। বিচিত্র গাছপালা ও ফুলের বিচিত্র ব্যবহার দেখে সত্যিই অবাক হয়েছি। যেমন- আদা গাছের পাতা রান্নায় ফ্লেভারের জন্য ব্যবহার করা হয় জানতামই না। খুব কম দামে তাজা ফলমূল ও শাকসবজি পাওয়া যায়। কলা, কমলা, আনারস, পেঁপে-এগুলো তো খেয়ে দেখতেই হবে। কারণ সেখানকার মাটির গুণে ফলের স্বাদ এখানকার চেয়ে অনেক বেশি। 

বৌদ্ধমন্দির স্বর্ণজাদি পরিদর্শন

এটি স্বর্ণমন্দির নামেই বেশি পরিচিত। ইতিহাসের প্রতি টান থাকলে এ মন্দির অবশ্যই দর্শণ করা উচিত। গৌতম বুদ্ধের জীবনের বিভিন্ন ঘটনা ভাস্কর্যের মাধ্যমে শৈল্পিকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে এখানে। আর এর উজ্জ্বল সোনালী বর্ণ এবং স্থাপত্যশৈলী নজর কেড়ে নেয়।

মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্সের লেকের পাড়ে

মেঘলা

মেঘলা পর্যটন কমপ্লেক্স আজীবন সমতলে বাস করা বাঙালিদের পাহাড়ে ওঠা-নামার সত্যিকার অনুভূতি দেবে। পুরো সফরে এতটা ক্লান্ত হইনি যতটা মেঘলায় গিয়ে হয়েছি! তবে জল-পাহাড়-সবুজের সমন্বয়ে জায়গাটি বেশ সুন্দর। এখানে দুটি ঝুলন্ত সেতু এবং একটি মিনি চিড়িয়াখানা রয়েছে। 

নীলাচল পাহাড়ের চূড়ায় আমরা

নীলাচল

বিকেলে দেখা পেলাম অপরূপা নীলাচলের । নামটি আসলেই সার্থক। মনে হয় যেন সবুজে মোড়ানো পাহাড়গুলো আকাশের নীল আঁচল দিয়ে ঢাকা। মেঘের ছায়া পড়ে কিছু কিছু জায়গা গাঢ় নীলবর্ণ ধারণ করে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২০০০ ফুট উঁচু পাহাড়ের কিনারে দাঁড়িয়ে চারপাশের দৃশ্য কি যে অপূর্ব লাগে নিজ চোখে না দেখলে অনুমান করাও সম্ভব না। 

স্থানীয় পাহাড়ি রেস্টুরেন্টে রান্না করা রকমারি খাবার।

স্থানীয় খাবারে নৈশভোজ

বাঁশ করুল, পাহাড়ি কচু, মুরগির চাটনী, সামুদ্রিক মাছ, মুন্ডি (নুডুলস জাতীয় খাবার), দেশি মুরগি ভুনা- আমার কাছে ওদের রান্না খুব সুস্বাদু মনে হয়েছে। রাতে খাবার পর সাঙ্গু নদীর উপরে তৈরি রেস্তোরাঁয় বসে রবীন্দ্রসঙ্গীত শুনতে শুনতে অপার্থিব জগতে হারিয়ে গিয়েছিলাম। 

নীলগিরির অপার সৌন্দর্য

নীলগিরি

পরদিন খুব সকালে রওনা দিলাম নীলগিরির পথে। বেশ খানিকটা উপরে উঠতেই পাহাড় ঘিরে মেঘের খেলা দেখতে পেলাম। মনে হতে লাগলো আমাদের চাঁন্দের গাড়ি বুঝি পৃথিবীর শেষ প্রান্তের দিকে যাচ্ছে। এরপরে কোথাও কিছু নেই। নীলগিরির কাছাকাছি পৌঁছানোর সময় শুভ্র মেঘ ভেসে এসে শরীর ছুঁয়ে যেতে লাগলো। আর হিমশীতল ঠান্ডা মেঘের পরশে আমরা শিহরিত হলাম বারবার। 

২২০০ ফুট উচ্চতার নীলগিরির চূড়া ঠিক ছবির মতো সুন্দর। এতদিন উপরে তাকিয়ে মেঘ দেখতাম, এবার নিচে তাকিয়ে দেখেছি। কোনো উপমাই এর সৌন্দর্য প্রকাশ করার মতো উপযুক্ত নয়। তাই বৃথা চেষ্টা করলাম না। 

নীলগিরি থেকে ফেরার পথে গেলাম চিম্বুক পাহাড়ে। সেখানকার দৃশ্যই অন্য রকম সুন্দর। 

শৈলপ্রপাত

এরপর শৈলপ্রপাত ঝর্ণা। অত্যন্ত মনোমুগ্ধকর এই ঝর্ণাটি বেশ বড়। এর পানি এত স্বচ্ছ যে মানুষ সরাসরি খাওয়ার জন্য ব্যবহার করে। ঝর্নাটির আশপাশের পাথরগুলো খুব পিচ্ছিল হওয়ায় শুধু ঠান্ডা পানিতে পা ভিজিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হলো। 

পাহাড়ের বুক চিরে বয়ে চলা স্বচ্ছ জলের নদী সাঙ্গু

সাঙ্গু নদী

বিকেলে আরেক রূপসী সাঙ্গু /শঙ্খ নদী ভ্রমণ। দুপাশে পাহাড় নিয়ে মাঝখানে স্রোতস্বিনী রূপের বহর নিয়ে বয়ে চলেছে। সরাসরি ঝর্ণার পানি আসায় এর পানিও অত্যন্ত পরিষ্কার। পাহাড়ের গায়ে প্রাকৃতিক কারুকার্য এত মনোমুগ্ধকর যে এক মুহূর্তের জন্যও চোখ সরানো যায় না।

সূর্যাস্তের পর পানিতে অপূর্ব লাল আভা দেখা যায়। অন্ধকার হওয়ার পর সাঙ্গু ব্রিজের চমৎকার আলোকসজ্জার প্রতিফলনে নদীর পানি বিস্ময়কর রূপ ধারণ করে। ব্রিজের ওপর থেকে বুঝতেই পারিনি এই নদী এতটা সুন্দর, বাংলাদেশের অন্য নদীগুলো থেকে একদম আলাদা।            

বান্দরবানের সবচেয়ে চমৎকার দিকটিই তো বলা হয়নি। পাহাড়ি মানুষের মন পাহাড়ের মতোই বিশাল। প্রকৃতির সাথে মানুষের মনের যে প্রত্যক্ষ যোগাযোগ আছে সেটা ওদের সাথে না মিশলে বোঝা যাবে না। এই সফরে আমাদের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি এ মানুষগুলো। ওদের সার্বক্ষণিক সঙ্গ আমাদের ভ্রমণকে সত্যিকার অর্থে সার্থক করে তুলেছে। আবার যদি বান্দরবান যাই নদী, পাহাড়, সবুজের টানে নয়, ওদের মায়া, আন্তরিকতা, আতিথেয়তার টানেই যাবো। 

মেঘের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার এইতো সুযোগ

এবার ফেরার পালা। এত অল্প সময়ে অনেক কিছুই দেখা হলো না। আরেকবার সময় নিয়ে এসে আলীকদম, থানচি যাওয়ার পরিকল্পনা করতে করতে পৌঁছে গেলাম আরেক রূপনগরী কক্সবাজারে। 

সমুদ্র যতবারই দেখি ততবারই নতুন লাগে। মনে হয়, আগে তো এত সুন্দর লাগেনি! মানুষের মুগ্ধ হওয়ার ক্ষমতা নাকি দিন দিন কমে, আমার হচ্ছে উল্টোটা। আমার দেশটা সত্যিই অনেক সুন্দর।

লেখক: শাহজিয়া শাহরিন আনিকা

শেয়ার করুন