না খেতে পেরে বিশ্বে প্রতি মিনিটে ১১ জন করে মারা যাচ্ছে। অর্থাৎ করোনায় মারা যাচ্ছে মিনিটে ৭ জন, আর ক্ষুধায় ১১ জন। এই তথ্যটি গত বছরের। এই বছরের সংখ্যাটা আরো কিছুটা বেশি। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন চলাকালে বিশ্ব নেতাদের সামনে গত ২০ সেপ্টেম্বর ২০২২ বিশ্বের ৭৫টি দেশের ২৩৮টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা উদ্বেগের সাথে একটি চিঠি উপস্থাপন করেন। তাদের মতে, বর্তমান বিশ্বের প্রায় ৩৪ কোটি ৫০ লক্ষ মানুষ চরম ক্ষুধার সঙ্গে লড়ছে। ২০১৯ সালের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। চরম ক্ষুধা নিয়ে বিশ্বে প্রতিদিন মারা যাচ্ছে ১৯ হাজার ৭০০ মানুষ। এই প্রাচুর্য ও প্রযুক্তির বিশ্বে এর চাইতে দুঃখজনক নির্মম লজ্জাজনক সংবাদ বা তথ্য আর কী হতে পারে? নিশ্চয়ই না।
আমার এক শুভাকাংখী কয়েকদিন আগে একটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেন, ‘‘পৃথিবীতে এক মাত্র মানুষই ক্ষুধা না থাকলেও খায়। অন্যান্য প্রাণী এমনকি হিংস্র সিংহ বা বাঘেরাও ক্ষুধা ব্যতীত প্রাণী শিকার করেনা। মানুষ কিন্তু ক্ষুধা না থাকলেও তার ঘরের রেফ্রিজারেটরে প্রচুর খাবার ভরে রাখে।’’ অর্থাৎ পৃথিবীর একটা অংশে খাদ্য উপছে পড়ছে, নষ্ট হচ্ছে (একটি তথ্য মতে বুফেতেই প্রায় ৪৫ শতাংশ খাবার নষ্ট হয়), অন্য প্রান্তে এক টুকরোর রুটির জন্য মারা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে এটি হচ্ছে বাস্তব চিত্র। আর এই কারণে খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে যারা ভাবেন, কাজ করেন, তারা উদ্বেগের সহিত জাতিসংঘকে জানিয়েছেন। চরম ক্ষুধার মধ্যেও ১৫ কোটি মানুষের অবস্থা আরো করুণ। আর এই প্রতি তিন জনের মধ্যে দুই জন হলো গৃহযুদ্ধ, সহিংস, সামরিক দ্বন্দ্ব, যুদ্ববিধস্ত দেশ ও এলাকাগুলোতে।
এখানে বলে রাখা দরকার, ক্ষুধা মুক্ত পৃথিবী গড়তে বিশ্বনেতাদের প্রতিশ্রুতি ছিল। কিন্ত তা সত্ত্বেও এই শতকে সোমালিয়া দুর্ভিক্ষ পরিস্থিতি থেকে মুক্ত হতে পারেনি। বিভিন্ন তথ্যের ভিত্তিতে জানা যায় যে, কয়েকটি কারণে পৃথিবীতে খাদ্যের অভাব দেখা দেয়, দিতে পারে। যেমন- ১. যুদ্ধ (বিভিন্ন ধরনের যুদ্ধ- যা বিশ্বে চলমান) ২. রোগ (বিভিন্ন ধরনের রোগ, মহামারি (করোনা, ডায়রিয়া, ইত্যাদি), সংক্রামক ও অসংক্রামক রোগ, ৩. প্রাকৃতিক দুর্যোগ (বন্যা, খরা ইত্যাদি)। করোনা মহামারী বিশ্বের অর্থনীতিকে লন্ডভন্ড করে দিচ্ছে। এর মধ্যে যুক্ত হয়েছে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। আরো রয়েছে বিভিন্ন দেশের গৃহযুদ্ধ, সহিংস, সামরিক দ্বন্দ্ব, জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাব, আবহাওয়া পরিবর্তন ইত্যাদি। এই সকল কারণে বিভিন্ন দেশের সাথে খাদ্যের শৃঙ্খলা ভেঙ্গে পড়ছে, খাদ্যের যোগান বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে। সরবরাহ কমে যাওয়ায় দ্রব্য মূল্য বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিশ্বের সকল দেশে প্রায় ৪০শতাংশ দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশ একটি কৃষিপ্রধান দেশ। বৈশ্বিক মন্দার প্রভাব এই দেশেও পড়েছে। ২০২৩ সালের এই বৈশ্বিক মন্দা আরো কঠিন হবে বলে বিশ্বনেতারা মনে করেন। আমাদের দেশে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা এই বিষয়ে খুবই সতর্ক। তিনি বার বার বলেছেন, কৃষি উৎপাদন বাড়াতে। যাতে বাংলাদেশ আসন্ন অভাব থেকে মুক্ত থাকতে পারে। তিনি সম্প্রতি বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষি পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান ও বিশ্ব খাদ্য দিবসে বলেন, ‘‘আমি আবারো অনুরোধ করছি, কোন খাদ্যের অপচয় নয়। খাদ্যের উৎপাদন বাড়ান। যার যেখানে যতটুকু জমি আছে বাড়ান। সারা বিশ্বে দুর্যোগের যে ঘনঘটার আভাস আমার পাচ্ছি, তার থেকে বাংলাদেশকে সুরক্ষিত করুন।’’
আন্তর্জাতিক দারিদ্ররেখা – ক্রয়ক্ষমতার সমতা অনুসারে (পিপিপি) একজন লোকের দৈনিক আয় ১ ডলার ৯০ সেন্ট-এর কম হলে হতদরিদ্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। পিপিপি অনুযায়ী (২০১৬) ডলারের মান ধরা হয়েছে ৩২ টাকা হারে। সে হিসাবে বাংলাদেশের মোট ২ কোটি ৪১ লক্ষ লোক দৈনিক ৬১ টাকা ৬০ পয়সা কম আয় করেন। অর্থাৎ আমাদের দেশে প্রায় ২ কোটি ৪১ লক্ষ লোক হতদরিদ্র। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর মতে (২০২২), বাংলাদেশের সবচেয়ে দরিদ্র জেলা কুড়িগ্রাম। এই জেলায় ৭০ শতাংশ মানুষ দরিদ্র (৫৪ শতাংশ মানুষই হতদরিদ্র)। আর চতুর্থ অবস্থানে বান্দরবান পার্বত্য জেলা। এখানে ৭৫ শতাংশ মানুষ দরিদ্র (৫০ শতাংশ মানুষই হতদরিদ্র)। পরিসংখ্যান মতে, কুড়িগ্রাম জেলায় রাজীবপুর উপজেলায় দেশে সবচেয়ে বেশি দরিদ্র মানুষ বসবাস করেন। এখানে প্রায় ৭৯ দশমিক ৮০ শতাংশ মানুষই দরিদ্র। দ্বিতীয় অবস্থানে আছে বান্দরবানের থানচি উপজেলা। এখানে দরিদ্র মানুষের বসবাস ৭৭.৮০ শতাংশ। থানচিতে বার্ষিক খাদ্যঘাটতির পরিমাণ ৯৮১.৫৯ মেট্রিক টন।
এদিকে, বান্দরবান পার্বত্য জেলায় পাহাড়িদের মধ্যে অধিকাংশ মানুষ জুমচাষী। জুম চাষ মূলত প্রকৃতির উপর নির্ভরশীল। আবহাওয়া ভালো হলে জুম চাষ ভালো হয়। আবহাওয়া বৈরি হলে জুম চাষের ফসল তেমন ভালো হয়না। এ বছর (২০২২) বৈরি আবহাওয়া জুমচাষ তেমন ভালো হয়নি। ইতিমধ্যে জুম চাষে ফলন ভালো না হওয়ার সংবাদ স্থানীয়, জাতীয় অনলাইনসহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। বিভিন্ন পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্যের মতে, বান্দরবান পার্বত্য জেলায় এই বছর প্রায় ৮ জাহার ৭৪৭ হেক্টর জমিতে জুমচাষ হয়েছে। কিন্তু বৈরি আবহাওয়া ও কোনো কোনো পাহাড়ে, জুমে ইঁদুরের আক্রমণ-এর কারণে জুমের ফলন কম হওয়ায় পাহাড়ের মানুষজন খাদ্য নিয়ে খুব চিন্তায় আছে। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, বিশ্বব্যাপী খাদ্য সংকট, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সতর্ক থাকা এবং জমি ফেলে না রেখে উৎপাদন বাড়ানোর আহবান- পাহাড়ের মানুষের কাছে কতটুকু পৌঁছেছে? এই বিষয়ে পাহাড়ের দরিদ্র, হতদরিদ্র মানুষ কতটুকু সতর্ক?