পৃথিবীতে রয়েছে কত অদ্ভূত আর বিচিত্র রকম পেশা। সেগুলোর মধ্যে অন্যতম এক অদ্ভূত পেশা হলো মৃত মানুষের জন্য কান্না করা।
ভারতের রাজস্থানে রুদালি নামের এক নারী সম্প্রদায় বহুকাল ধরে বসবাস করে আসছে। তারা সাধারণত কালো কাপড় পরিধান করে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে বেড়ায়। তারা বিশ্বাস করে যমদূতেরা কালো রং পছন্দ করে। এজন্য তারা যমদূতকে আকৃষ্ট করার উদ্দেশ্যে এমন কালো রংয়ের কাপড় পরিধান করে থাকে। তারা মৃত মানুষের জন্য কান্নাকাটি করেই জীবিকা নির্বাহ করে। রাজস্থানের ধনী বা জমিদার বাড়ির কোনো ব্যক্তি মৃত্যুবরণ করলে শোক পালনের জন্য ডাক পড়ে এই রুদালি সম্প্রদায়ের নারীদের। এমনকি কোনো ব্যক্তি মুমূর্ষূ অবস্থায় থাকলেও কান্নাকাটি করার জন্য ভাড়া করে রাখা হয় তাদেরকে। তারা এসেই বুক চাপড়ে ও চোখের পানিতে বুক ভাসিয়ে এক হৃদয়বিদারক পরিবেশের সৃষ্টি করে। এসব দেখে আশেপাশের মানুষরাও অশ্রুসিক্ত না হয়ে পারেন না। মৃত ব্যক্তির সৎকার হয়ে গেলেই তাদের দায়িত্ব শেষ। তবে বড় পরিসরে শোক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলে তাদেরকে কয়েকদিন পর্যন্ত কান্নাকাটি করে যেতে হয়।
রুদালিরা এরকম কান্নাকাটি করার জন্য বেশকিছু পদ্ধতি অবলম্বন করে থাকে। তারা চোখে পানি আনার জন্য এক ধরনের পাহাড়ি গাছের শিকড় ব্যবহার করে, যেটি গ্লিসারিনের মতো কাজ করে। এটি চোখে লাগানোর সাথে সাথে চোখ দিয়ে অঝোরে পানি ঝরতে থাকে। আবার এদের মধ্যে কেউ কেউ চোখে এক ধরনের কালি ব্যবহার করে থাকে। এই কালি চোখে দিলেই চোখে জ্বালাপোড়া শুরু হয় এবং একসময় চোখ দিয়ে পানি বের হতে থাকে। আবার অনেক রুদালি নিজেদের জীবনের কষ্টের ঘটনা মনে করে সত্যিকারের কান্নাকাটি করে থাকে। কিন্তু দু:খের বিষয় তাদের এই কান্না উপলব্ধি করতে পারে না কেউই।
তবে রুদালি সম্প্রদায় যে কান্নাকাটি করে প্রচুর অর্থ উপার্জন করে বিষয়টা মোটেও তেমন নয়। তাদেরকে এই কান্নাকাটি করার জন্যে পারিশ্রমিক হিসেবে খুবই সামান্য বা নামমাত্র অর্থ দেয়া হয়। তা দিয়ে হয়তো তাদের দু’বেলা দু’মুঠো খাবারও জোটে না। তবে জমিদারদের নিকট হতে তারা দান হিসেবে কখনো কখনো বাসি রুটি, পরিধানের জন্য কালো কাপড় পেয়ে থাকে।
নিচু জাত এবং সেখানকার সামাজিক নিয়মের কারণে রুদালিরা বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হতে পারে না। ধারণা করা হয়, তারা যদি সাংসারিক সুখ পেয়ে যায় তাহলে মৃত মানুষদের নিয়ে কান্নাকাটি করার জন্য ভাড়া হিসেবে আর লোক পাওয়া যাবে না। তাই তাদেরকে বৈবাহিক বন্ধনের মাধ্যমে পরিবার গঠন করতে দেয়া হয় না।
তবে তারা জন্ম দিয়ে থাকে জমিদারদের অবৈধ সন্তান। সেই সন্তান যদি কন্যা হয় তবে তার কপালে লেখা থাকে অসহনীয় দুর্ভাগ্য। বড় হওয়ার পর ঐ কন্যাসন্তানকে রুদালি সম্প্রদায়ে যোগ দিতে বাধ্য করা হয়। আবার পুত্রসন্তান এলে যে ভাগ্য সুপ্রসন্ন ব্যাপারটা তাও নয়। এমন ছেলেদেরকে সেখানে অবৈধ বা জারজ সন্তান হিসেবে গণ্য করা হয় এবং তাদেরকে ঘৃণার চোখে দেখা হয়।
রুদালি সম্প্রদায়ের এমন দু:খের জীবনকাহিনী নিয়ে ১৯৯৩ সালে বলিউডে “রুদালি” নামক একটি সিনেমাও তৈরি করা হয়েছিল। এই সিনেমায় উঠে এসেছিলো রুদালিদের জীবনের বাস্তব চিত্র। রুদালিদের নিজেদের জীবনও বেদনায় পরিপূর্ণ। সে বেদনার কথা চাপা পরে থাকে আড়ালে। তারা সারাজীবন অন্যের মৃত্যুতে কেঁদে বুক ভাসিয়ে দেয়। কিন্তু এদের মৃত্যুর সময় কেউ এক ফোঁটা চোখের পানিও ফেলে না। যেমন অদ্ভূত তাদের পেশা তেমনই অদ্ভূত তাদের জীবন।