কক্সবাজারের রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরে প্রায় ১০ লক্ষ শরণার্থী রয়েছে। গত বৃহস্পতিবার সেখানে প্রথমবারের মতো কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত রোগী শনাক্ত হয় যার মাধ্যমে একটি ভয়ংকর মানবিক বিপর্যয়ের পূর্বাভাস দিচ্ছে সহায়তা সংস্থাগুলি।
বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ক্রমশই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এবং শরণার্থীদের উপর এটির প্রকোপ পড়তে পারে বলে আশঙ্কা করছিলেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ এবং রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের নেতারা । গত বৃহস্পতিবার, এই আশঙ্কার বিষয়টি নিশ্চিত হয় যখন জাতিসংঘ এক রোহিঙ্গা শরণার্থীসহ মোট ২ জনকে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত বলে ঘোষণা দেয়। ধারণা করা হচ্ছে ভাইরাসটি শরণার্থী শিবিরে ব্যাপক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ সেখানে শরণার্থীরা প্রচন্ড গরম আবহাওয়াতে এবং একটি কক্ষে প্রায় ১০ জন করে বাস করে। পাশাপাশি তাদের পর্যাপ্ত পরিমাণে বিশুদ্ধ পানির অভাব রয়েছে। তারা তাদের খাদ্যসামগ্রী সারিবদ্ধভাবে একটি নির্দিষ্ট জায়গা থেকে সংগ্রহ করে। যার ফলে তাদের পক্ষে কোনোভাবেই সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখা সম্ভব নয়।
মায়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে আসা অনেক শরণার্থীই যথাযথ টিকা না পাওয়ায় আগে থেকেই স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রয়েছে, বলছেন স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা।
দাতব্যসংস্থা ‘‘দ্যা মেডিসিন সানস ফ্রন্টিয়েরেস’’ এক বিবৃতিতে বলেছে, কোভিড-১৯ এর পূর্বে শরণার্থীদের এক তৃতীয়াংশ মানুষ শ্বাসনালীর রোগের জন্য চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করতো। যার মাধ্যমে বোঝা যায় তারা আগে থেকেই বেশ ঝুঁকিতে ছিলো। কিন্তু তাদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা ছিল বেশ সীমিত।
বেশকিছু স্বেচ্ছাসেবী করোনাভাইরাস সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করার উদ্যোগ নেয়। কিন্তু সম্প্রতি শিবিরে ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করায় এই কার্যক্রম স্থগিত হয়ে যায়। ফলে সেখানকার মানুষ সঠিক তথ্য ও উপদেশ পাচ্ছে না যা তাদের উদ্বেগ কয়েক গুণ বাড়িয়ে দিচ্ছে।
মোহাম্মদ সেলিমের (৩৬) ছয় সদস্যের পরিবার থাকে এই শরণার্থী শিবিরে। তিনি বলেন, ‘‘সবাই বলাবলি করছে ক্যাম্পে দুইজন রোগী পাওয়া গিয়েছে এবং সেইখান থেকেই আমি এই রোগটি সম্পর্কে জানতে পারি।” তিনি আরও জানান, এনজিওগুলো বিভিন্ন ধরনের স্বাস্থ্য উপদেশ দিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মানুষ যেভাবে চলাফেরা করছে তাতে ভাইরাসটি সহজেই পুরো ক্যাম্পে ছড়িয়ে পড়বে বলে তিনি উদ্বেগ প্রকাশ করেন। ‘‘মানুষ ক্যাম্পের বাইরে ও ভেতরে অবাধে চলাফেরা করছে। তারা বিভিন্ন জায়গায় একসাথে জমায়েত হচ্ছে। স্থানীয় চায়ের দোকানগুলোতে ভীড় লেগেই আছে’’, বলেন মোহাম্মদ সেলিম। তিনি আরও বলেন, তিনি তার চার সন্তানকে ঘরে রাখার চেষ্টা করছেন কিন্তু সবসময় তাদেরকে ঘরের ভেতর আটকে রাখা সহজ হচ্ছে না।
কুতুপালং ক্যাম্পের শীর্ষস্থানীয় এক নেতা শফিউল্লাহ জানান, অবস্থা বিবেচনা করে লকডাউন আরও জোরদার করা হবে। ইন্টারনেট সেবার উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার জন্য তিনি প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ‘‘ইন্টারনেট আমাদের মানুষকে সাহায্য করবে। কারণ এটি একটি বিশাল তথ্যভান্ডার।’’
এপ্রিলের প্রথম দিকে কক্সবাজারে করোনাভাইরাস শনাক্তের পরীক্ষা শুরু হয়। বৃহস্পতিবার পর্যন্ত ১০৮ জন শরণার্থীকে পরীক্ষা করা হয়।
এই পর্যন্ত বাংলাদেশে কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়েছে ১৮ হাজারের বেশি এবং মৃত্যু হয়েছে ২৮৩ জনের। সেভ দ্যা চিলড্রেন বাংলাদেশের পরিচালক ড. শামীম জাহান বলেন, করোনাভাইরাস ইতোমধ্যে দেশের স্বাস্থ্যখাতকে বিচলিত করে দিয়েছে। তিনি আরও বলেন, ‘‘পুরো দেশে ১৬ কোটি মানুষের জন্য মাত্র ২০০০ ভেন্টিলেটরের ব্যবস্থা রয়েছে। এবং রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবিরের ১০ লক্ষ মানুষের জন্য এই মুহূর্তে কোনো আইসিউর ব্যবস্থা নেই। এখন এই ভাইরাসটি পৃথিবীর সবচাইতে বড় শরণার্থী শিবিরে প্রবেশ করেছে। আর আমরা একটি বাস্তব চিত্র দেখতে পাচ্ছি যেখানে হাজার হাজার মানুষ কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে মারা যাবে। এই মহামারীটি বাংলাদেশকে এক দশক পিছিয়ে নিয়ে যাবে।’’
ব্রিটেনের বার্মিজ রোহিঙ্গা সংস্থা বলছে, রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সুরক্ষার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আরও বৃহত্তর পরিসরে কাজ করা দরকার। একই সাথে তারা বাংলাদেশ সরকারকে শিবিরগুলিতে কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দেওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছে।
সংস্থাটির প্রধান তুন খিন বলেন, ‘‘আমরা বাংলাদেশকে আহ্বান জানাচ্ছি বিভিন্ন সহায়তা সংস্থাগুলি থেকে সকল প্রকার বিধিনিষেধ তুলে নেয়ার জন্য। এই মহামারীর সময়ে তাদেরকে যে মানুষগুলির দরকার তারা যাতে তাদের কাছে যেতে পারে এবং ভাইরাসটি ছড়িয়ে পড়া ঠেকাতে প্রয়োজনীয় সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারে। এ সময়ে তিনি ইন্টারনেট সেবার উপর থেকেও সকল নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়ার কথাও বলেন।
তিনি আরও বলেন, ‘‘রোহিঙ্গারা মায়ানমার সরকারের চালানো নির্মম গণহত্যা থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে পালিয়ে এসেছিলো। পুরো পৃথিবীকে এখন শিবিরের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে সাহায্য করতে হবে। কারণ এখানেই তারা নিরাপদ বোধ করছে।”