বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলের পানিতে বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কক্সবাজারের সঙ্গে টেকনাফের সড়ক যোগাযোগ। চট্টগ্রামের পাঁচ উপজেলার লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। বন্যার্তদের জন্য খোলা আশ্রয় কেন্দ্রে চলছে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ।
পানির চাপে হালদা বেড়িবাঁধ ভেঙে যাওয়ায় হাটহাজারীর শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। চট্টগ্রামের সঙ্গে খাগড়াছড়ি ও রাঙ্গামাটির সড়ক যোগাযোগ ব্যাহত হচ্ছে। খাগড়াছড়ির বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে।
ফেনীর মুহুরী নদীর ভাঙনে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হয়ে পড়েছে। মঙ্গলবার রাতে ফুলগাজী উপজেলার উত্তর দৌলতপুর ও বরইয়া অংশ এবং পরশুরাম উপজেলার দুর্গাপুর গ্রাম সংলগ্ন নদীর পাড় ভেঙে এসব গ্রাম তলিয়ে যায়। পাহাড় ধসের কারণে রুমা উপজেলার সড়ক যোগাযোগ বুধবারও বিপর্যস্ত ছিল। এদিকে খাগড়াছড়ির দীঘিনালার বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত রয়েছে। উপজেলার প্রায় তিন হাজার মানুষ এখনও আশ্রয় কেন্দ্রে দিন কাটাচ্ছে।
উখিয়া (কক্সবাজার): টানা বর্ষণে পানিতে তলিয়ে গেছে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়কের বিভিন্ন পয়েন্ট। এতে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে কক্সবাজার-টেকনাফ সড়ক যোগাযোগ। বুধবার সকাল ৭টা থেকে যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
উখিয়া উপজেলা শ্রমিক নেতা মো. শফি সওদাগর জানান, প্রবল বর্ষণে মহাসড়কের চেইন্দা, বাংলাদেশ বেতারের কক্সবাজার কেন্দ্র গেট ও জুহুর মিয়ার কাঠি রাস্তার মাথা পয়েন্টসহ কয়েকটি স্থানে এক কিলোমিটার সড়ক প্রায় কোমর পানিতে ঢুবে গেছে। এ ছাড়াও থাইনখালীতে রাস্তার ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে।
সড়কের উভয় পাশে শত শত যানবাহন আটকা পড়েছে। উখিয়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা নিকারুজ্জামান চৌধুরী জানান, মঙ্গলবার থাইংখালী এলাকার কিছু স্থানে সড়কের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হয়েছিল। পরে তা স্বাভাবিক হয়ে যায়। বুধবার সকালে কিছুটা সময় সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হলেও বৃষ্টি কমে যাওয়ায় এখন সড়ক যোগাযোগ স্বাভাবিক হয়ে আসছে।
চট্টগ্রাম: চট্টগ্রাম-রাঙ্গামাটি সড়কের চট্টগ্রাম অংশে বিভিন্ন স্থানে সড়কে পানি কমে আসায় যান চলাচল বুধবার দুপুর থেকে সীমিত আকারে শুরু হলেও চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি সড়ক বন্ধ ছিল দ্বিতীয় দিনের মতো। চট্টগ্রাম জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আবুল কালাম আজাদ যুগান্তরকে বলেন, উত্তর চট্টগ্রামের, রাউজান, ফটিকছড়ি এবং দক্ষিণ চট্টগ্রামের সাতকানিয়া ও চন্দনাইশ উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। কোথাও পানি কমলেও কোথাও পানি বেড়েছে।
রাউজান উপজেলার সব ক’টি ইউনিয়ন এবং বাকি উপজেলাগুলো আংশিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাউজানে ২০ টন চাল ও ৫ লাখ টাকা, হাটহাজারীতে ৫ টন চাল, ফটিকছড়িতে ১০ টন চাল ও নগদ পঞ্চাশ হাজার টাকা, সাতকানিয়ায় ১০ টন চাল ও নগদ ৫০ হাজার টাকা এবং চন্দনাইশে ৫ টন চাল বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। রাউজান উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. শামীম হোসেন যুগান্তরকে জানান, হলুদিয়া, ডাবুয়া, চিকদাইর ইউনিয়ন থেকে পানি নেমে যাওয়া শুরু করলেও পাহাড়ি ঢলে নতুন করে প্লাবিত হয়েছে পূর্ব গুজরা, পশ্চিম গুজরা, উড়িরচর ও নোয়াপাড়া ইউনিয়ন।
উপজেলার ৫০ হাজার মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এর মধ্যে শতাধিক পরিবার তাদের ঘরবাড়ি হারিয়েছে। ২২টি আশ্রয় কেন্দ্র খোলা হয়েছে। হাটহাজারী উপজেলার চিকদাইর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মো. নুরুল আবসার লাবু জানান, গুমানমর্দন ও ছিপাতলী এলাকায় বাঁধের ভাঙা অংশ দিয়ে হালদা নদীর পানি জনপদে প্রবেশ করায় নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে।
ফটিকছড়ি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা দীপক কুমার রায় জানান, ফটিকছড়ির প্রায় ৫০ জাহার মানুষ বৃষ্টি ও পাহাড়ি ঢলে কমবেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। উপজেলার সব ক’টি ইউনয়নে পানি উঠলেও অপেক্ষাকৃত নিচু সমিতিরহাট ও রোসাঙ্গিরি ইউনিয়নের লোকজন বুধবারও পানিবন্দি ছিলেন। উপজেলার সব ক’টি প্রাথমিক বিদ্যালয় আশ্রয় কেন্দ্র হিসেবে খোলা রাখা হয়েছে।
হাটহাজারীতে শতাধিক গ্রাম প্লাবিত
হাটহাজারী: হালদা নদীর পানি বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় নদী ভাঙন মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। তলিয়ে গেছে অর্ধশতাধিক সড়ক। চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি মহাসড়কের বেশ কয়েকটি স্থান তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল ব্যাহত হচ্ছে।
উপজেলার পূর্ব ফরহাদাবাদ, বংশাল, পূর্ব ধলই, কাজীপাড়া, সেকান্দর পাড়া, মাইজপাড়া, হাধুর খীল, পূর্ব এনায়েতপুর, পেসকারহাট, উত্তর সাদেক নগর, কুমারী কুল, বালুখালী, গুমানমর্দন, কাজির খীল, জাফরাবাদ, রহিমপুর, ইছাপুর, ছিপাতলী, উত্তর মেখল, মধ্যম মেখল, ভবনীপুর, মাছুয়া ঘোনা, উত্তর মাদার্শা, মধ্যম মাদার্শা, দক্ষিণ মাদার্শা, শিকারপুর, বাতুয়া, খন্দকিয়া, বুড়িশ্চর, পৌর এলাকার ফটিকা, মিরের খিল, মোহাম্মদপুর, মুন্সির মসজিদ, পূর্ব দেওয়ান নগর, কাচারী সড়কসহ বেশকিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে। উপজেলা প্রকৌশলী কামরুজ্জামান জানান, পাহাড়ি ঢলে সড়কের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
চট্টগ্রাম-খাগড়াছড়ি-রাঙ্গামাটি মহাসড়কের এনায়েতপুর, বড়দীঘি পাড়া ও হাটহাজারী-রাউজান মহাসড়কের সুবেদার পুকুর পাড়, ইছাপুর বাজারের একাধিক স্থান পানি নিচে তলিয়ে যাওয়ায় যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আক্তার উননেছা শিউলী জানান, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তদের নিরাপদে সরিয়ে আনার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে।
ফেনীতে ১০ গ্রাম প্লাবিত
ফেনী: টানা বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে মুহুরী নদীর তিনটি স্থান ভেঙে অন্তত ১০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। মঙ্গলবার রাতে ফুলগাজী উপজেলার ইউনিয়নের উত্তর দৌলতপুর ও বরইয়া অংশ এবং পরশুরাম উপজেলার দুর্গাপুর দুটি অংশে ভাঙন সৃষ্টি হয়। এতে ঘনিয়া মোড়া, উত্তর দৌলতপুর, দক্ষিণ দৌলতপুর, উত্তর বরইয়া ও দক্ষিণ বরইয়া প্লাবিত হয়েছে। একই দিন রাতে পরশুরাম উপজেলার চিথলিয়া ইউনিয়নের দুর্গাপুর গ্রামের মুহুরী নদীর বেড়িবাঁধ ভেঙে বিস্তীর্ণ এলাকা প্লাবিত হয়েছে। ফুলগাজীর দৌলতপুর ইউপি সদস্য তাজুল ইসলাম জানান, স্থানীয়রা অনেক চেষ্টা করেও ভাঙন ঠেকাতে পারেনি।
পাহাড়ি ঢলে দুপুর থেকে ছাগলনাইয়া মহুরীগঞ্জ সড়টিও তলিয়ে গেছে। ফেনী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী কহিনুর আলম বলেন, মঙ্গলবার মুহুরী নদীর পানি বিপদসীমার ৬০ সে.মি. ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছিল। এতে ওই সব এলাকার লোকালয়ে পানি ঢুকে পড়েছে। ফুলগাজী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা কিসিঞ্জার চাকমা ভাঙন এলাকা পরিদর্শন করেছেন।
খাগড়াছড়িতে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত
উপজেলার প্রায় তিন হাজার মানুষ এখনও আশ্রয় কেন্দ্রে দিন কাটাচ্ছে। খাগড়াছড়ি শহর থেকে পানি নেমে যাওয়ার পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। দীঘিনালার দক্ষিণ হাচিনসনপুরের বাসিন্দা অনিল চাকমা বলেন, ‘সারা বছরের জন্য সঞ্চিত গোলার ধান, চাল ও সরিষা বানের পানিতে ভেসে গেছে। এখন কী খেয়ে বাঁচব তা জানি না। বাড়ি থেকে পানি নেমে গেছে।’ ছোট মেরুং বাজারের ব্যবসায়ী মো. সোহেল জানান, ‘২০০৭ সালে পর এটি সবচেয়ে বড় বন্যা। বৃষ্টি না থাকলেও বন্যার পানি না কমায় বন্যা ভোগান্তি বেড়েছে।’
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) শেখ শহীদুল ইসলাম জানান, ‘উপজেলায় প্রায় সাত থেকে দশ হাজার মানুষ পানিবন্দি। এদের মধ্যে ২২টি আশ্রয় কেন্দ্রে তিন হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে। বন্যাদুর্গতদের জন্য পর্যাপ্ত খাবারে ব্যবস্থা রয়েছে।’ জেলা প্রশাসক রাশেদুল ইসলাম জানান, বন্যাদুর্গতদের জন্য পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা রয়েছে। ’
চকরিয়ায় বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকছে গ্রামে
কক্সবাজারের চকরিয়ায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বেড়িবাঁধ ভেঙে মাতামুহুরী নদী থেকে লোকালয়ে তীব্র বেগে ঢলের পানি ঢুকে যাচ্ছে। বুধবার ভোরে চকরিয়া উপজেলার কোনাখালী ও বিএমচর ইউনিয়নের মধ্যবর্তী স্থান কইন্যারকুম নামক এলাকায় ওই বেড়িবাঁধ ভেঙে যায়। চকরিয়ার উজানের দিকে কয়েকটি ইউনিয়নে বন্যার পানি কমে এলেও উপকূলীয় এলাকার কয়েকটি ইউনিয়নে বন্যার পানি বাড়ছে।
বেড়িবাঁধের প্রায় ১৫ মিটার ভেঙে গেছে। ওই ভাঙন দিয়ে তীব্র বেগে পানি ঢুকছে। এতে বিএমচর, কোনাখালী, পূর্ববড়ভেওলা, ঢেমুশিয়া ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় পানি ঢুকছে। কক্সবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সাবিবুর রহমান জানান, আগে থেকেই এলাকাটি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। বোর্ডের কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা সেখানে কাজ করছে।
কুলাউড়া রাজনগরের শতাধিক গ্রাম প্লাবিত
কুলাউড়া: মনু নদীর পানি বিপদসীমার ১৭৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জেলার কুলাউড়া ও রাজনগর উপজেলায় মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধের ৬টি স্থানে ফাটল দেখা দিয়েছে মঙ্গলবার রাতে। ২ উপজেলার ৪টি ইউনিয়নে শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন।
বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে শরীফপুরের সঙ্গে কুলাউড়া উপজেলা সদরের এবং বাংলাদেশ-ভারত সড়ক যোগাযোগ। মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রনেন্দ্র শংকর চক্রবর্তী বলেছেন, বৃষ্টি বন্ধ না হলে ঝুঁকিপূর্ণ আরও ৫-৭ স্থানে ভাঙন দেখা দিতে পারে। কুলাউড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা চৌধুরী গোলাম রাব্বী জানান, ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তা করা হবে।
আমতলা বিজিবি ক্যাম্প সংলগ্ন মনু প্রতিরক্ষা বাঁধে ভাঙন শুরু হলে গ্রামবাসী ও বিজিবি সদস্যরা বালুর বস্তা ফেলে ভাঙন ঠেকান। তবে বাঘজুর ও তেলিবিল গ্রামে বাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পড়ে। এতে বাঘজুর, তেলিবিল, চাঁনপুর, খাম্বারঘাট, শরীফপুর, বটতলা, সঞ্জরপুর গ্রাম তলিয়ে যায়। চাতলা সেতুর উত্তর দিকের বাঁধও ভেঙে নছিরগঞ্জ, ইটারঘাট, মনোহরপুর, নিশ্চিন্তপুর, মাদানগর গ্রাম প্লাবিত হয়।
টিলাগাঁও ইউনিয়নের বালিয়া গ্রামে ভাঙনে বালিয়া, সন্দ্রাবাজ, মিয়ারপাড়া, ডরিতাজপুর, লহরাজপুর, তাজপুরসহ ১০টি গ্রাম তলিয়ে যায়। পৃথিমপাশা ইউনিয়নের শিকড়িয়া ডোমাবিলে ভাঙনের ফলে শিকড়িয়া, গণকিয়া, আলীনগর গ্রাম প্লাবিত হয়। এছাড়াও রাজনগর উপজেলা কামারচর ইউনিয়নের ভোলানগর গ্রামে মনু নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধে সৃষ্ট ভাঙনের ফলে ৭-৮টি গ্রাম তলিয়ে যায়।