এক বন্ধু ছবি পোস্ট করেছে তার কোন এক শুভদিন উদযাপন এর। সেই পোস্টে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে দেখি এলাহী কান্ড! কত লোকের যে মন খারাপ তাকে দাওয়াত দেয়া হয়নি বলে! পোস্টদাতা মোমেন্ট শেয়ার করে কী বিপদেই না পড়লো! ফেইসবুকের যুগে এই সমস্যা বেশ প্রকট। আগে কে কী উদযাপন করছে তা জানার অত সুযোগ ছিলনা। কিন্তু এখন সবাই সবকিছু জেনে যাচ্ছে সোশাল মিডিয়ার কল্যাণে। কিন্তু এর ব্যবহারকারী হিসেবে যতটা সংবেদনশীল এবং দায়িত্বশীল আচরণ করা উচিত তা আমরা কতটা করছি? একটা মানুষ তার সব উদযাপনে সবাইকে ডাকতে পারবেনা, এটাই স্বাভাবিক। সেটা আমি আপনি সবাই জানি। তার কোন বিশেষ কিছুর শেয়ারিং এ আপনার দুঃখিত হবার কিছু নেই। কিংবা খুশি হতে না পারলেও অন্ততঃ পোস্টদাতার মুডটা নষ্ট না করলেও তো হয়।
আরেকদিন একজন স্ট্যাটাস দিলো যে সবার সুখ দেখলে নিজের জীবনটাই তুচ্ছ মনে হয়। মনে হয় যে সে কী করলো জীবনে! সবার মত এত সুন্দর নয় কেন তার জীবন?
সোশ্যাল মিডিয়ার রঙিন বাস্তবতা বা ভার্চুয়াল রিয়েলিটিতে বসবাস করা মানুষজনের মাঝে আজকাল তাই হতাশাবোধের পরিমাণও বেশি দেখা যাচ্ছে। আমি কেন ওর মত নই, কিংবা আমার জীবন কেন অন্য আরেকজনের মত নয়, অথবা আমাকে যেহেতু কেউ দাওয়াত দেয়নি তাই হয়তো আমাকে কেউ পছন্দ করেনা এইসব হাহাকারবোধ গ্রাস করে নিচ্ছে স্বাভাবিক জীবনের স্বাচ্ছন্দ্যকে।
সম্প্রতি ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্টের গবেষণায় দেখা গেছে, যারা সোশ্যাল মিডিয়াতে দিনের বেশিরভাগ সময় ব্যয় করেন, তাদের মধ্যে হতাশা, বিষন্নতা এমনকি আত্মহত্যার প্রবণতাও বেশি।
ইউনিভার্সিটি অফ পেনসিলভিনিয়ার অধ্যাপক ডঃ মেলিসা জি হান্ট, পরীক্ষণমূলক তথ্য ও স্ব-পর্যবেক্ষণ গবেষণার মাধ্যমে প্রমাণ করেন যে, বেশিমাত্রায় সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার মানুষের ভালো থাকার উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। ফিয়ার অফ মিসিং আউট (Fear of Missing Out-Fomo) এই টার্মটাও তিনি ব্যবহার করেন এ গবেষণার একটি ফল হিসেবে। ‘সবাই অনেক ভাল আছে আমাকে ছাড়াই, আমাকে হয়তো আর কারও প্রয়োজন নেই অথবা আমাকে কেউ মনে রাখেনা বা আমি গুরুত্বপূর্ণ না’- এধরনের অহেতুক শঙ্কাও তৈরি হয় সোশ্যাল মিডিয়ার একপেশে সব পোস্ট দেখে।
মানুষ সাধারণত তার দৈনন্দিন জীবনের ভাল কিছু কিংবা ভাললাগার কিছুই সোশ্যাল মিডিয়াগুলোতে প্রকাশ করে। সেখানে বিপরীত অংশটুকু থাকে একেবারেই অনুপস্থিত। কিন্তু সবার জীবনেই ব্যর্থতা, দুঃখ, খারাপ লাগা থাকে। কিন্তু সাধারণত সেগুলো প্রকাশ করার মত বিষয় বলে আপনি আমি কেউই মনে করিনা। কিন্তু অন্যরাও যে ঠিক এমনটাই মনে করছে এবং তার আলোকিত দিকটাই প্রকাশ করছে, তা ভুলে যাই। আর তখন অন্যদের চাকচিক্যময় কিংবা সরল জীবন দেখলেই আমরা নিজের দুর্দশার কথা ভেবে অসুখী হয়ে পড়ি।
অথচ কারও সাথে নিজের তুলনা করা নিতান্তই বোকামি। এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ার কল্যাণে বিভিন্ন ঘুরে বেড়ানোর অথবা সামাজিক অনুষ্ঠানের ছবি মারফত আমরা খুব সহজেই একে অন্যের আর্থ সামাজিক অবস্থার তুলনা শুরু করে দেই। কখনোবা অসুস্থ প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হই নিজেদের অজান্তেই। এই সবকিছুই মারাত্মক ক্ষতির কারণ বলে মনে করেন অধ্যাপক ড. মেলিসা।
ইউপেনের ঐ গবেষণায় এও উঠে এসেছে যে, যারা বাস্তব জীবনে বেশি সময় ব্যয় করেন অর্থাৎ সোশ্যাল মিডিয়াতে যাদের উপস্থিতি সামান্য এবং বন্ধু, পরিবার এমনকি অফিসের সহকর্মীদের সাথে বেশি সময় ব্যয় করেন তারা তুলনামূলকভাবে বেশি স্বস্তিতে থাকেন। তাদের মাঝে হতাশাবোধ কম হয়।
এই পরিস্থিতি থেকে মুক্তি পেতে কিছু বিষয় খেয়াল রাখা জরুরি।
যা দেখবেন তার সব সত্য নয়-
সোশ্যাল মিডিয়াতে পাওয়া যেকোন কিছুই শতভাগ সত্য নয়। একজন অসুস্থতায় জর্জরিত মানুষও কখনো তার মলিন মুখের ছবি পোস্ট করতে চাননা। তাই হাসি আনন্দের মোড়কে আপনার সামনে আসা সব মুখের পেছনেই অন্য গল্প থাকলে থাকতেও পারে। সে ব্যাপারে সংবেদনশীল আচরণ করুন। অযাচিত বা হিংসাত্মক মন্তব্য কিংবা ধারণা পোষণ কোনটাই শোভন নয়।
বাস্তব জীবনটাই আসল জীবন-
সোশ্যাল মিডিয়াতে আমরা যুক্ত হই সামাজিকতার খাতিরে, নেটওয়ার্কিংয়ের জন্য। অথচ একটু খেয়াল করলেই বোঝা যায়, তিনশ’ বন্ধুর মাঝে নিজেকে প্রকাশ করতে করতে হয়তো সামনে বসে থাকা একসময়ের সবচেয়ে কাছের বন্ধুটির খবরই নেওয়া হচ্ছেনা। হয়তো এই মুহূর্তে আপনাকে তার খুব প্রয়োজন। কারো সাথে সুন্দর সম্পর্ক গড়তে চাইলে তার ভালর সাথে খারাপটাও জানতে হবে। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়াতে এ ব্যাপারটা বেশিরভাগক্ষেত্রেই অনুপস্থিত।
নিজেকে সংযত করুন-
প্রযুক্তির বিকাশের এই সময়ে এসে সোশ্যাল মিডিয়াতে একেবারে অনুপস্থিত থাকা হয়তো সম্ভব না। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের জন্য এটি প্রায় অসম্ভব। কিন্তু সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারে সংযত আচরণ এক্ষেত্রে ভূমিকা রাখতে পারে। দিনে আধ ঘন্টার বেশি সময় সেখানে ব্যয় না করার সংকল্প করুন এবং সেই সময়টা হাঁটতে বেরিয়ে পরুন, বই পড়ুন, প্রিয়জনের সাথে সময় কাটান কিংবা স্বেচ্ছাসেবামূলক কাজে বেশি সময় দিন যেন আপনার সময়টা সঠিক ভাবে কোন কল্যাণে ব্যয় হয়।
শেষ করছি ছোট্ট একটি গল্প দিয়ে। একটা বন্ধুদের গ্রুপে একজনের ঝোঁক বোর্ড গেইমের দিকে। সোশাল মিডিয়া তাকে অতটা টানেনা। পাবজি বা লুডো স্টারের মত ভার্চুয়াল কোন গেইমে সময় না কাটিয়ে বরং বন্ধুদের সাথে সামনাসামনি বসে বোর্ডগেইম খেলতে খেলতে আড্ডা দিতেই তার বেশি ভাল লাগে। সেই একই গ্রুপে আরেকজন ছিল যে সোশ্যাল মিডিয়াতে খুব সচল। তার অনেক ভার্চুয়াল বন্ধু। বন্ধুর ডাকে বোর্ড গেইমের আসরে আসবার তার সময় নেই। কিংবা আসলেও ইন্সটাগ্রামের জন্য সেই ছবি পোস্ট করাতেই বেশি ব্যস্ত সে। সেই বন্ধুটির একদিন একটা দুর্ঘটনা ঘটলো। দুর্ঘটনার পর তার ঐ বোর্ড গেইম পাগল বন্ধুটিই তাকে দেখাশোনা করতে লাগলো। স্বভাবতই দুর্ঘটনার খবর সে সোশ্যাল মিডিয়ায় জানালো। সেই পোস্টে কমেন্টের বন্যা ভেসে গেল। রসিকতামূলক পোস্টদাতা হিসেবে খ্যাতি আছে বলে অনেকে সেই পোস্ট না পড়েই হাহা রিয়্যাকশন দিয়ে গেল। কিন্তু ওর সত্যিকারের সাহায্য করতে থাকলো এই কাছের বন্ধুরাই। সোশ্যাল মিডিয়ার সেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটানো বন্ধুরা কিন্তু রয়ে গেল ভার্চুয়াল আশীষ দেয়া পর্যন্তই। কাজেই বুঝে দেখুন, জীবনের মূল্যবান সময়গুলো কোথায় ব্যয় করবেন। কারো সুখে সুখ না পাওয়ার কষ্ট নিয়ে, অযাচিত বন্ধুর সংখ্যা বাড়িয়ে, নাকি অন্যের সাথে নিজের জীবনের তুলনা করে? সত্যিকারের জীবন থেকে সরে গিয়ে অর্থবহ জীবন না কাটিয়ে হতাশা, অপ্রাপ্তির জীবন কেনইবা বেছে নেওয়া! নিজের সকল অর্জন, প্রাপ্তিকে উপেক্ষা করে কেনই বা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলা, ‘ও পাড়েতে সর্ব সুখ, আমার বিশ্বাস!’