খয়েরি রঙের কাপবোর্ডের ওপরে এলোমেলো করে রাখা কিছু আচারের বয়াম। পাশেই পুষ্টিবর্ধক পানীয়র বোতল। এগুলোর ওপরেই লেমিনেটেড করে রাখা বসুন্ধরা কিংস দলের বিরাট একটা ছবি। যে ছবিতে অধিনায়কত্বের বাহুবন্ধনী পরে দাঁড়িয়ে রোকনুজ্জামান কাঞ্চন। হাতের মুঠোয় ধরা ক্লাবটির লাল রঙের পতাকা।
ক্লাবের পতাকার মতো যেন বসুন্ধরা কিংসকেও নিজের হাতের মুঠোয় ধরে রেখেছেন অধিনায়ক কাঞ্চন। যোগ্য নেতার মতোই দলকে টেনে তুলেছেন চ্যাম্পিয়নশিপ লিগ থেকে প্রিমিয়ারে। প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে সুযোগ পেয়েই বসুন্ধরার প্রিমিয়ারে উঠে যাওয়ার পেছনে বড় অবদান কাঞ্চনের। এখন পর্যন্ত ১১ গোল করে লিগের সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনি। ৮ নভেম্বর লিগ শেষ করতে চান সর্বোচ্চ গোলদাতা হিসেবেই।
পেশাদার লিগের ক্লাবগুলো যখন ‘কাঞ্চন চলে না’ বলে রায় দিয়ে ফেলেছিল, তখনো নিজের ওপর আস্থা হারাননি। গত মৌসুমে পেশাদার লিগে দল পাননি বলে একটুও ভেঙে পড়েননি। এবার যোগ দেন বসুন্ধরা কিংসে। বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় ভাড়া বাড়িতে সাত মাস ধরে চলছে ক্লাবের ক্যাম্প। কাল দুপুরে সেখানে বসেই কাঞ্চন বলছিলেন এত দিন ধরে খেলে যাওয়ার রহস্যটা, ‘এই বয়সেও এমন পারফরম্যান্স করতে পেরে ভীষণ ভালো লাগছে। আসলে সবকিছু নির্ভর করে নিজের ওপর। এখনো ফিটনেস ধরে রেখেছি। ইচ্ছাশক্তি আছে বলেই এখনো খেলছি।’
তা বয়স কত কাঞ্চনের? পাসপোর্ট অনুযায়ী ৩৭। তবে বাংলাদেশের প্রায় প্রচলিত রীতি অনুযায়ী আসল বয়সটা এর চেয়ে এক-দুই বছর বেশি। মুখে হাসি এনে তা জানান তিনি নিজেই। জাতীয় দলে খেলেছেন। ছিলেন ২০০৩-এর সাফ ফুটবলে সোনাজয়ী দলের সদস্য। সতীর্থরা সবাই অবসরে। অথচ বয়সকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে দিব্যি খেলে চলেছেন কাঞ্চন, যা মনে করিয়ে দেয় ক্যামেরুনের ফরোয়ার্ড রজার মিলার কথা।
অবসর থেকে ফিরে ১৯৯০ বিশ্বকাপে খেলতে নেমে ৩৮ বছর বয়সী মিলা একের পর এক গোল করে দেখিয়ে দিয়েছিলেন, ‘ফুটবলে বয়স কোনো ব্যাপারই না।’ আর ১৯৯৪ বিশ্বকাপে তো ইতিহাসেই নাম লিখিয়েছিলেন সবচেয়ে বেশি বয়সে গোল করে। বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলেও সবচেয়ে বেশি বয়সী স্কোরার সম্ভবত কাঞ্চনই! কাঞ্চনের অনুপ্রেরণা অবশ্য রজার মিলা নন, ৪০ বছর পর্যন্ত খেলে যাওয়া ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কিংবদন্তি রায়ান গিগস, ‘গিগসের অনুশীলনের ভিডিও এখনো আমি দেখি।’
ফকিরেরপুল, অগ্রণী ব্যাংক, ফরাশগঞ্জ, আবাহনী, মোহামেডানের পর একটানা ১০ মৌসুম মুক্তিযোদ্ধার হয়ে খেলেছেন কাঞ্চন। সর্বশেষ প্রিমিয়ার লিগে খেলেছেন ২০১৫-১৬ মৌসুমে। পারিশ্রমিক নিয়ে মুক্তিযোদ্ধার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বনিবনা না হওয়ায় রাগ করে আর খেলেননি পরের মৌসুমে। গত মৌসুমে কোনো দলই পাননি। শেখ রাসেল ক্রীড়া চক্রের কোচ শফিকুল ইসলাম মানিক নবাগত বসুন্ধরা কিংস দল গড়ার দায়িত্ব পাওয়ার পরই কাঞ্চনের কথা মনে পড়ে তাঁর। মানিক সেই কারণটাও বললেন, ‘গত বছর কক্সবাজারে বিচ ফুটবল খেলার সময় কাঞ্চনের ফিটনেস দেখে আমি মুগ্ধ হই।
পরে ওকে বলি, নতুন একটা দল চ্যাম্পিয়নশিপ লিগে আসছে, সেখানে খেলবে নাকি? ও রাজি হয়ে যায়। কাঞ্চন ছাড়াও বাদশা, ফারুকসহ অভিজ্ঞ কিছু খেলোয়াড় দিয়েছিলাম। কাঞ্চনকে বলেছিলাম, তুমি দলের দায়িত্ব নাও। দলকে চ্যাম্পিয়ন করো। ও আমার কথা রেখেছে।’
পরশু কমলাপুর স্টেডিয়ামে কাঞ্চনের খেলা দেখতে এসেছিলেন স্ত্রী রুমা আক্তার, ছেলে সানোয়ার হোসেন, মেয়ে চাঁদমণি। গ্যালারিতে ছিলেন কাঞ্চনের মা ও শ্বশুরও। উত্তরায় তাঁর নিজের হাতে গড়া ফোরটি প্লাস ফুটবল ক্লাবের শতাধিক খেলোয়াড়ও এসেছিলেন। মুন্সিগঞ্জে কাঞ্চনের গ্রামের বাড়ি থেকে এসেছিল মালখানগর ফ্রেন্ডস অ্যাসোসিয়েশনের প্রায় ৮০ জন ফুটবলার।
কাঞ্চনের গোলেই দল চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর তাঁকে কাঁধে তুলে ল্যাপ অব অনার দিয়েছে সতীর্থরা। কাঞ্চনের মনে যা ফিরিয়ে এনেছে সাফে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সেই স্মৃতি, ‘এই বয়সে এসে সতীর্থ ও ক্লাব কর্মকর্তাদের কাছ থেকে যে সম্মান পেয়েছি, তাতে আমি কৃতজ্ঞ। সাফের চ্যাম্পিয়ন হওয়ার মতোই আনন্দ হচ্ছিল আমার।’
পরশু রাত থেকে শুভেচ্ছা আর অভিনন্দনে ভিজছেন কাঞ্চন। মুঠোফোন বেজেই চলেছে। মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্র থেকে পরিচিতজনদের শুভেচ্ছাবার্তা পাচ্ছেন। এত ভালোবাসায় মুগ্ধ কাঞ্চন খেলে যেতে চান আরও দুই-তিন বছর। তাহলে আগামী মৌসুমে কি বসুন্ধরার হয়ে প্রিমিয়ারে খেলবেন? কাঞ্চন অনুমিত উত্তরই দিলেন, ‘বসুন্ধরা ক্লাব কর্তৃপক্ষ যদি মনে করে, কাঞ্চনের কাছ থেকে কিছু পেতে পারে, তাহলে তো সমস্যা নেই।
তবে আমি পেশাদার ফুটবলার, এখানেই খেলতে হবে, এমন কোনো কথা নেই। যারা মূল্যায়ন করবে, সেখানেই খেলব।’ না খেললেও একটা তৃপ্তি তো থাকছেই, ‘দলকে চ্যাম্পিয়ন করে গেলাম। আমি ইতিহাসের অংশ হয়েছি। যত দিন বসুন্ধরা থাকবে, আমাকে ঠিকই মনে রাখবে।’
তাঁর কাঞ্চন নামটা রেখেছিলেন এক চাচি। ওই চাচি বলতেই পারেন, ‘দেখো, এই বয়সেও কেমন কাঞ্চনের মতোই জ্বলজ্বল করছে আমাদের কাঞ্চন!’