কক্সবাজারের টেকনাফে তালিকাভুক্ত শীর্ষ ইয়াবা ব্যবসায়ীদের দেখা মিলছে না। আতঙ্ক ছড়িয়েছে সাধারণ মানুষের মধ্যেও। হাটবাজারগুলো ফাঁকা হয়ে পড়েছে।
মাদকবিরোধী অভিযানে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে এ পর্যন্ত টেকনাফের দুজন এবং নেত্রকোনায় টেকনাফের বাসিন্দা আরও দুজন, মোট চারজন নিহত হওয়ার পর গডফাদাররা আত্মগোপনে রয়েছেন। এ ছাড়া শহরের আশপাশে চলাচলকারী নানা রঙের মোটরসাইকেলগুলো এখন আর দেখা যাচ্ছে না।
স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, গত ১৬ মে অভিযান শুরু হওয়ার পর থেকে দোকানপাট, তরিতরকারি, মাছ ও মাংসের বাজারে ক্রেতার সংখ্যা কমে গেছে। তবে জিনিসপত্রের দাম কমছে না। গত বছর এ সময়ে যে ব্যবসা হয়েছিল, এবার তার অর্ধেকও হচ্ছে না।
নাফ নদী ও সাগরের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে মিয়ানমার থেকে টেকনাফে ইয়াবা বড়ি পাচারের ঘটনাটি দীর্ঘদিনের। এসব ইয়াবা পাচারের ঘটনা দেশব্যাপী আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হলেও কার্যত গডফাদাররা তেমন ধরা পড়েননি। বিভিন্ন আইন প্রয়োগকারী সংস্থা বড় বড় ইয়াবার চালান আটক করলেও অধিকাংশ সময় মালিকেরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে গেছেন।
আইন প্রয়োগকারী সংস্থা সূত্র জানায়, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে মে পর্যন্ত ১ কোটি ৭২ লাখের বেশি ইয়াবা উদ্ধার করেছেন বিজিবি, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সদস্যরা। সর্বশেষ গত ৩ এপ্রিল জেলা গোয়েন্দা পুলিশের তৈরি করা ইয়াবার চোরাচালানের তালিকায় ১ হাজার ১৫১ জনের নাম রয়েছে। এর মধ্যে টেকনাফ শহরেই ৫২ গডফাদারসহ ৯১২ জন রয়েছেন। এর মধ্যে ৩০ জনই হলেন সাংসদ বদির ভাই, বোন, ভাগনে, মামাতো ভাই, মামা, বেয়াইসহ নিকটাত্মীয়।
পুলিশ ও গোয়েন্দা সূত্র জানায়, সাংসদ বদির ছোট ভাই মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১২-১৫ জনের একটি চক্র রয়েছে। চক্রটি নাফ নদীর চৌধুরীপাড়া, জালিয়াপাড়া, নাইট্যংপাড়ার কয়েক কিলোমিটার এলাকা নিয়ন্ত্রণ করে। আর সাংসদের ভাগনে সাহেদুর রহমান ও মুফিজুর রহমানের নেতৃত্বে সাবরাং ইউনিয়নের সমুদ্র উপকূলের মুন্ডারডেইল, নয়াপাড়া, কাটাবনিয়াপাড়ার এলাকা দিয়ে ইয়াবার চোরাচালান খালাস করা হয়।
প্রশাসন সূত্র বলছে, বাংলাদেশে চোরাই পথে ইয়াবা পাচারের জন্য মিয়ানমারের সীমান্তবর্তী এলাকায় স্থাপিত হয়েছে ৩৭টি কারখানা। মিয়ানমারের ৮ সংগঠনের নিয়ন্ত্রণে এ কারখানাগুলো পরিচালিত হয়। মিয়ানমারভিত্তিক ১০ ডিলার ওই সব কারখানায় তৈরি করা ইয়াবা পৌঁছে দিচ্ছে টেকনাফে।
টেকনাফের বিজিবির অধিনায়ক লে. কর্নেল আছাদুদ জামান চৌধুরী প্রথম আলোকে বলেন, বিজিবির টহল জোরদার এবং গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানোর ফলে এখন সমুদ্রপথে ইয়াবা বেশি পাচার হচ্ছে বলে শোনা যাচ্ছে। গত ৫ মাসে বিজিবির সদস্যরা ৬৯ লাখ ৭৩ হাজার ১৭৫টি ইয়াবা উদ্ধার করেন। নৌযানসহ ১২৩ জন পাচারকারীকে আটক করা হয়।
গত ২৪ মে রাতে নেত্রকোনার মদনপুরের মেনাংয়ে পুলিশ-মাদক চোরাকারবারী বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফের হ্নীলার পশ্চিম সিকদারপাড়ার মৌলভি দিল মোহাম্মদের ছেলে মো. ইসমাঈল ও মোহাম্মদ হোছেনের ছেলে মো. ওসমান নিহত হন। পরদিন সাবরাং ইউপির সদস্য আক্তার কামাল ও ২৭ মে র্যাবের সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে টেকনাফ পৌরসভার ৩ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর ও সাবেক উপজেলা যুবলীগের সভাপতি একরামুল হক নিহত হন। এরপর পাল্টে যায় টেকনাফের চিরচেনা দৃশ্য। হাটবাজারসহ কোথাও মাদক ব্যবসায়ী গডফাদারদের প্রকাশ্যে দেখা যাচ্ছে না।
গত ৩০ মে সকালে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কার্যালয়ে উপজেলা আইনশৃঙ্খলা কমিটির চোরাচালানবিরোধী সভায় অধিকাংশ জনপ্রতিনিধি অনুপস্থিত ছিলেন।
এ অবস্থার মধ্যেই ১ জুন সৌদি আরব যান সাংসদ আবদুর রহমান বদি। বদির ব্যক্তিগত সহযোগী হেলাল উদ্দিন বলেন, ওমরাহ পালন শেষে ১৭ জুন তাঁর দেশে ফেরার কথা।
এ প্রসঙ্গে টেকনাফ মডেল থানার ওসি রনজিত কুমার বড়ুয়া প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ এ পর্যন্ত শীর্ষ কয়েকজন ইয়াবা ব্যবসায়ীর বাড়িতে অভিযান চালিয়েছে। তবে নিজেদের আলিশান বাড়ি রেখে ইয়াবা ব্যবসায়ীরা দুবাই, মালয়েশিয়া, ভারত ও ওমরাহ পালনের নামে সৌদি আরব এবং দেশের বিভিন্ন জায়গায় আত্মগোপন করেছেন। অনেকে ট্রলারযোগে সমুদ্রপথে মিয়ানমারের উপকূলীয় এলাকায় গিয়ে আশ্রয় নিয়েছেন। আবার কেউ কেউ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে আটক এড়াতে রোহিঙ্গা শিবিরে আশ্রয় নিয়েছেন বলে খবর পাওয়া যাচ্ছে। কোনো কোনো বাড়িতে বড় বড় তালা ঝুলছে।
জেলা পুলিশ সুপার এ কে এম ইকবাল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, এ পর্যন্ত ৪২০ জন মাদক ব্যবসায়ীকে আটক করা হয়েছে। ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে সাড়ে চার লাখ।
হাটবাজারে ভিড় নেই
গত সোমবার বেলা একটা থেকে বিকেল সাড়ে চারটা পর্যন্ত টেকনাফ পৌরসভার বড় বাজারের কোম্পানি মার্কেট, ফরিদ কমপ্লেক্স, বার্মিজ মার্কেট, বাসস্টেশনের আলো শপিং সেন্টার, গণি মার্কেট, মাছবাজার, তরিতরকারির বাজার ও মাংসের বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ক্রেতাসাধারণের তেমন ভিড় নেই। অধিকাংশ দোকানি পণ্যের পসরা সাজিয়ে অলস বসে আছেন।
বাসস্টেশনের মাছ ব্যবসায়ী নবী হোসেন বলেন, বাজারের ইলিশ, লইট্টা, রুপচাঁদা, কোরালসহ বিভিন্ন প্রকারের মাছের প্রাচুর্য থাকলেও ক্রেতা নেই। গত বছর রোজায় দিনে ২০-২৫ হাজার টাকার মাছ বিক্রি হলেও এখন দৈনিক ৩-৪ হাজার টাকার বেশি হচ্ছে না। যারা এসব মাছ কিনত, তারা এলাকাছাড়া।
টেকনাফের আলো শপিং সেন্টারের ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি সাইফুল ইসলাম বলেন, ‘এ সেন্টারের আড়াই শতাধিক রকমারি দোকানপাট রয়েছে। তবে বেচাকেনা বলতে কিছু নেই। এমনও দোকান আছে, সারা দিনে ২০০ টাকার মালামালও বিক্রি হচ্ছে না। তারপরও এ অভিযানকে আমরা স্বাগত জানাই।’
সূত্র: প্রথম আলো