ঢাকা রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের নবম শ্রেণির ছাত্র নাইমুল আবরার রাহাত (১৫) নিহতের ঘটনায় ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে প্রথম আলোর সম্পাদকসহ সংশ্লিষ্টদের লিগ্যাল নোটিশ দেয়া হয়েছে।
কলেজটির সাবেক শিক্ষার্থী ওবায়েদ আহমেদের পক্ষে রোববার রেজিস্ট্রি ডাকযোগে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ফাইজুল্লাহ ফয়েজ নোটিশটি পাঠিয়েছেন।
দৈনিক প্রথম আলোর প্রকাশক ও সম্পাদক, কিশোর আলোর সম্পাদক, তথ্য মন্ত্রণালয়, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর এ নোটিশ পাঠানো হয়েছে।
তবে ক্ষতিপূরণের অর্থ প্রথম আলোর প্রকাশক, সম্পাদক এবং কিশোর আলোর সম্পাদককে দিতে বলা হয়েছে।
নোটিশে ক্ষতিপূরণের পাশাপাশি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কোনো ধরনের অনুষ্ঠান পরিচালনার ক্ষেত্রে বিশেষ নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য তথ্য মন্ত্রণালয় সচিব, শিক্ষা মন্ত্রণালয় সচিব এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের সচিবকে অনুরোধ জানানো হয়েছে।
এছাড়া নোটিশ প্রাপ্তির তিনদিনের মধ্যে প্রথম আলোর প্রকাশক, সম্পাদক এবং কিশোর আলোর সম্পাদকের কাছে ঘটনার ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে।
ওই ঘটনায় ক্ষতিপূরণের ১০ কোটি টাকা নিহত আবরার রাহাতের পরিবারকে হস্তান্তর করতে বলা হয়েছে।
তবে ক্ষতিপূরণ না দিলে প্রয়োজনীয় আইনি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে বলেও নোটিশে উল্লেখ করা হয়েছে।
শুক্রবার বিকালে কিশোর আলোর অনুষ্ঠানে বিদ্যুতায়িত হলে আবরারকে মহাখালীর ইউনিভার্সাল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নেয়া হয়। সেখানে চিকিৎসকরা তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
রাহাতের মৃত্যুর খবরে ব্যবস্থাপনা ও চিকিৎসায় অবহেলার অভিযোগ তুলে শনিবার ক্যাম্পাসে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ করেন কলেজের শিক্ষার্থীরা।
তারা সেখান থেকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে সিসিটিভির ফুটেজ প্রদানসহ চার দফা দাবি তুলে ধরেন।
অন্য দাবিগুলো হচ্ছে- অনুষ্ঠান ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে থাকা প্রতিষ্ঠান ও হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে লিখিত বক্তব্য দিতে হবে, গাফিলতির বিষয়টি স্বীকার করে পত্রিকায় বিবৃতি দিতে হবে এবং তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন ছাত্রদের হাতে পৌঁছাতে হবে।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মধ্যে এদিন তদন্ত কমিটি করেছে রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজ কর্তৃপক্ষ।
অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম আহমেদ বলেন, ‘নাইমুল আবরার রাহাতের মৃত্যুর ঘটনায় ৩ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। সাত দিনের মধ্যে কমিটিকে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে।’ এ ঘটনায় গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তিও দিয়েছে কলেজের সায়েন্স ক্লাব।
রাহাতের মৃত্যুর খবরে রাত থেকেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে শোক-নিন্দা এবং ‘ছাত্রের মৃত্যুর পরও অনুষ্ঠান চালিয়ে যাওয়া নিয়ে’ সমালোচনা শুরু হয়।
শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভ ও সমালোচনার পর শনিবার বিকালে এ ঘটনায় বিবৃতি দিয়েছে কিশোর আলো কর্তৃপক্ষও। কিশোর আলো সম্পাদক আনিসুল হক এক ফেসবুক পোস্টে দুঃখ প্রকাশ করেন।
এদিকে এ মৃত্যুর ঘটনায় প্রথম আলো কর্তৃপক্ষের (কিশোর আলো দৈনিক প্রথম আলোর সাময়িকী) অব্যবস্থাপনাকে দায়ী করে আজ ঢাকার কারওয়ান বাজারে সংবাদপত্রটির কার্যালয় ঘেরাও করতে একটি ফেসবুক ইভেন্ট খোলা হয়েছে।
রাহাতের মৃত্যুর ঘটনায় মোহাম্মদপুর থানায় একটি অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার বলেন, এ ঘটনায় পরিবার কোনো অভিযোগ দেয়নি। এ কারণে অপমৃত্যুর মামলা হয়েছে। তারা ময়নাতদন্ত ছাড়া লাশ নেবে- এজন্য একটি মুচলেকাও দেয়। আমরা লাশ পরিবারকে বুঝিয়ে দিয়েছি।
কলেজের দিবা শাখার ছাত্র আবরারের বাড়ি নোয়াখালী। সে সোনাইমুড়ী উপজেলার সোনাপুর ইউনিয়নের ধন্যপুর গ্রামের অধিবাসী সৌদি প্রবাসী মজিবুর রহমানের ছেলে। ঢাকার আগারগাঁওয়ে পরিবারের অন্য সদস্যদের সঙ্গে থাকত।
আবরারের বাবা মজিবুর রহমান বলেন, আমার ছেলে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে আহত হওয়ার পর সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ উদ্দেশ্যমূলকভাবে কালক্ষেপণ করে পাশে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে না নিয়ে মহাখালীতে ইউনিভার্সাল হাসপাতালে নেয়। সেখানে উপযুক্ত চিকিৎসা না পেয়ে কিছুক্ষণ পর মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে।
ছেলের লাশ ময়নাতদন্ত না করে আমাকে দিয়ে দেয়। বাবার কাঁধে ছেলের লাশ কত যে ভারী, তা একমাত্র আমিই বলতি পারি। এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্ত করে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দাবি করছি।
মজিবুর রহমান আরও বলেন, অনুষ্ঠান শুরু হয় সকাল ৮টায়। রাহাত বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় বিকাল ৪টায়, তার মৃত্যু হয় সন্ধ্যা ৭টায়। খবর মোবাইল ফোনে তার সহপাঠী লাভিব আমাদের জানায়। আমরা হাসপাতালে গিয়ে তার লাশ দেখতে পাই। দুই ভাই এক বোনের মধ্যে রাহাত সবার ছোট।
মোহাম্মদপুর থানার ওসি জিজি বিশ্বাস বলেন, ‘কি আনন্দ’ শিরোনামের ওই অনুষ্ঠানের জন্য তৈরি করা মঞ্চের পেছনে বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয় আবরার। আয়োজকরা তাকে মহাখালীর একটি হাসপাতালে নিলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
শনিবার কলেজের ফটকে মানববন্ধন ও বিক্ষোভে শিক্ষার্থীরা বলেন, ‘শুক্রবার আয়োজন যারা করেছেন, তারা নিজেদের দায় কতটুকু, তা তাদের প্রচারমাধ্যমে না জানালে পরবর্তী কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।’
‘তারা কেন আমাদের না জানিয়ে অনুষ্ঠান চালিয়ে গেল, পাশে হাসপাতাল থাকতে মহাখালীতে কেন নিয়ে গেল, মধ্যরাতে কেন জানাজা হল’- প্রশ্ন তোলেন তারা।
বিক্ষোভের একপর্যায়ে কলেজটির অধ্যক্ষ ব্রিগেডিয়ার জেনারেল কাজী শামীম ফরহাদ সেখানে উপস্থিত হন। তিনি ছাত্রদের নিজের শোকানুভূতির কথা জানিয়ে বলেন, ‘এই কলেজের সাবেক ছাত্র হিসেবে এবং অধ্যক্ষ হিসেবে আমার বড় দায়িত্ব রয়েছে।’ তিনি ঘটনার সুষ্ঠু তদন্তের বিষয়ে আশ্বস্ত করলে বিক্ষুব্ধ শিক্ষার্থীরা শান্ত হন।