মিয়ানমারের বুছিদং, রাছিদংয়ের বিভিন্ন এলাকা থেকে পালিয়ে আসা প্রায় অর্ধলাখ রোহিঙ্গা অবশেষে উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে ঠাঁই পেয়েছেন। গতকাল সকাল থেকে পায়ে হেঁটে এবং বিজিবির দেওয়া ট্রাকে করে তারা ক্যাম্পে ফেরেন।
এর আগে তিন দিন ধরে তারা উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়ার বিস্তীর্ণ ধানখেত, খেতের আইল ও সীমান্তের শূন্যরেখায় মানবেতর সময় কাটান। সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সিদ্ধান্ত না থাকায় এসব রোহিঙ্গা অন্যান্য অনুপ্রবেশকারীর মতো সরাসরি উখিয়া-টেকনাফের রোহিঙ্গা শিবিরে কিংবা লোকালয়ে আশ্রয় নিতে পারেননি।
সোমবার থেকে গতকাল সকাল পর্যন্ত খোলা আকাশের নিচেই থাকতে হয়েছে তাদের। দুর্ভোগ ও নানামাত্রিক সংকট থাকা সত্ত্বেও ক্যাম্পে যেতে পেরে নতুন করে আসা এসব রোহিঙ্গা বেশ উচ্ছ্বসিত। ঘটিবাটি কাঁধে ও স্বজনদের সঙ্গে নিয়ে বাঁধভাঙা জোয়ারের মতো উখিয়ার পালংখালী হয়ে বালুখালী ও কুতুপালংয়ের রোহিঙ্গা শিবিরের দিকে ছুটতে দেখা গেছে তাদের। অনেককে অসুস্থ আত্মীয়স্বজন ও বৃদ্ধ মা-বাবাকে কাঁধে নিয়ে সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে আঞ্জুমানপাড়া বিল পেরিয়ে আসতে দেখা গেছে।
গতকাল আঞ্জুমানপাড়া মসজিদের পাশে পাঁচ সদস্যের পরিবার নিয়ে ক্যাম্পে যাওয়ার পথে বুছিদংয়ের টমবাজার থেকে আসা জামাল হোসেন বলেন, ‘খোদা আঁরার দিকে চাইয়ি, তার অফুরান রহমত ও এ দেশের হুকুমতের অশেষ মেহেরবানিলায় আঁরা আজিয়ে আশ্রয় পাইর। ইয়ান যে আঁরার লাই হতবড় শুকরিয়া—ইয়ান হই শেষ গরিত ন পাইরগুম (খোদা আমাদের দিকে তাকিয়েছেন। তার অফুরন্ত রহমত ও এ দেশের সরকারের অশেষ মেহেরবানির জন্য আমরা আজকে এখানে আশ্রয় পেয়েছি। এটা যে কত বড় শুকরিয়া, তা বলে শেষ করতে পারব না)। ’ এ রকম অনেকেই তাদের উচ্ছ্বাস প্রকাশ করেছেন গতকাল রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যেতে যেতে।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, তিন দিন ধরে অভুক্ত এসব রোহিঙ্গা জমির আইল, চিংড়িঘের ও ধানিজমির কাদায় অবস্থান করায় তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েছেন। সেখানে একটি মসজিদের মাঠে অস্থায়ী মেডিকেল ক্যাম্পে অসুস্থদের চিকিৎসাসেবা দেওয়া হলেও তা ছিল রোগীর তুলনায় অপ্রতুল। আবার দেশি-বিদেশি অনেক সংস্থাকে অভুক্ত এই রোহিঙ্গাদের মধ্যে খাদ্য বিলি করতে দেখা গেছে। কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, ক্ষুধা-তৃষ্ণা ও নির্ঘুম রাত কাটানোর ফলে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছেন।
কোনো কিছু বলার শক্তিও তাদের নেই। ছয় দিন পায়ে হেঁটে আসার পর এখানে এসে যে সীমাহীন কষ্ট পেতে হয়েছে, তা বলে শেষ করা যাবে না। রাছিদংয়ের ঝুপারাং থেকে আসা নুরুল আলম বলেন, তাদের গ্রামগুলো বিচ্ছিন্ন এলাকা হওয়ায় তারা জীবন বাজি রেখে সেখানে থাকার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু মিয়ানমারের সামরিক জান্তা ও রাখাইন মগ-মুরংদের দল তাদের থাকতে দেয়নি। সাদা কার্ড ধরিয়ে দেওয়ার নামে তাদের অত্যাচার, জুলুম, মারধর, সহায়-সম্পদ লুটপাট শুরু করলে এক সপ্তাহ আগে তারা পাড়া ছেড়ে বের হন। আশপাশের ১৪টি গ্রামের অনেকগুলো পরিবার সীমান্তে পাড়ি জমানোর উদ্দেশ্যে পাহাড়ি পথ ধরে রওনা হয়।
সোমবার ভোররাতে আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তে এসে তারা বিজিবির বাধার মুখে আটকা পড়ে যায়। সেখানে তাদের তিন দিন অনেকটা না খেয়েই থাকতে হয়েছে। বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের ক্যাম্পে যাওয়ার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। আপাতত বালুখালী ও কুতুপালংয়ের অস্থায়ী ক্যাম্পেই তারা তাঁবু টাঙানোর সুযোগ পাবেন। এরপর নিবন্ধন করা হবে তাদেরও।
আইওএমের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের কুতুপালং ও বালুখালী ক্যাম্পে নিয়ে আসা হয়েছে। বিভিন্ন মেডিকেল সেন্টারে স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পাশাপাশি তাদের মধ্যে শুকনো খাবার ও ত্রাণসামগ্রীর কার্ড বিতরণ করা হয়েছে। আশা রাখি খাদ্য সংকট ও চিকিৎসাসেবা থেকে এদের কেউ বঞ্চিত হবে না। তাদের পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থার দিকটিকেও গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ’ এদিকে গতকাল আঞ্জুমানপাড়া থেকে ক্যাম্পে আসার সময় এসব রোহিঙ্গার অনেকের গাট্টি-বোঁচকায় তল্লাশি চালানো হয়েছে। মাদক বা অন্য কোনো অবৈধ জিনিস নিয়ে এ দেশে প্রবেশ করছে কি না তা যাচাই-বাছাই করে তাদের যেতে দেওয়া হয়।
কৃতজ্ঞতা- দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিন