আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের বর্তমান শতাধিক এমপির দলীয় মনোনয়ন পাওয়া প্রায় অনিশ্চিত। তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, অনিয়ম, ক্ষমতার অপব্যবহার, নিয়োগ বাণিজ্য, দলের মধ্যে কোন্দল সৃষ্টি, টেন্ডারবাজি, এলাকার দলীয় নেতা-কর্মীদের সঙ্গে অসদাচরণসহ নানাবিধ অভিযোগ রয়েছে। এ সব কারণে তৃণমূলের সংশ্লিষ্ট এমপিদের সাথে নেতা-কর্মীদের দূরত্ব দিন দিন বাড়ছে। এমন নেতিবাচক ভাবমূর্তির এমপির সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক স্তরের সর্বশেষ জরিপে অন্তত দশ ধরনের নেতিবাচক কর্মকাণ্ডে এমপিদের জড়িত থাকার এ সব তথ্য আওয়ামী লীগের হাইকমান্ডের হাতে এসেছে। এ দিকে তৃণমূলের নেতা-কর্মীরাও আগামী নির্বাচনে এ সব এমপির মনোনয়ন না দিতে দলের হাইকমান্ডের উপর এক ধরনের চাপ সৃষ্টি করছেন।
জানা গেছে, নেতাকর্মীদের কাছে স্বচ্ছ ভাবমূর্তি ও জনগণের কাছে গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে, এলাকায় সুপরিচিত, মানুষের কল্যাণে কাজ করেন, দক্ষ সংগঠক, সত্, নিষ্ঠাবান ও শিক্ষিত, এমন ব্যক্তিরাই দলীয় প্রতীক পাবেন। সাংগঠনিক কাজে সংশ্লিষ্ট না থাকলেও দলীয় আদর্শকে ধারণ করেন এমন ব্যক্তিদের মধ্য থেকে কাউকে কাউকে মনোনয়ন দেয়ার সম্ভাবনাও আছে। দলের হাইকমান্ড এ সব যোগ্যতাসম্পন্ন নেতাদের সারাদেশ থেকে বাছাই করছে। এবার দুইশ আসনে এমন প্রার্থী দেয়া হবে যারা লড়াই করে বিজয় নিশ্চিত করতে পারবেন তাদের। আবার ক্ষেত্রবিশেষে বিএনপির প্রার্থীর প্রভাব, গ্রহণযোগ্যতার বিপরীতে আওয়ামী লীগের প্রার্থী মনোনয়ন নির্ভর করবে । শতাধিক আসনে বিএনপির প্রার্থী কারা হচ্ছে সেটিও সার্বক্ষণিক পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। বর্তমান সংসদে স্বতন্ত্র এমপি রয়েছেন এমন কাউকে কাউকে দলে এনে মনোনয়ন দেয়া হতে পারে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, যেসব এমপি তৃণমূল নেতাকর্মী থেকে অনেক বিচ্ছিন্ন, এলাকায় গ্রহণযোগ্যতা নেই, ক্ষমতার দাপট, অহমিকা, প্রশাসনের ওপর প্রভাব বিস্তার করে নিজস্ব আলাদা বলয় সৃষ্টি করেছেন তারা এবার আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পাবেন না এটা অনেকটাই নিশ্চিত।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনাভোটে এমপি নির্বাচিত হয়ে অনেক এমপি নির্বাচনী এলাকায় পা দেননি। আবার কারও স্ত্রী, পুত্র, কন্যা, ভাই, ভাগ্নে, শ্যালক, শ্বশুরকে দিয়ে এলাকায় কর্মকাণ্ড পরিচালনা করেছেন। এ সব আত্মীয়-স্বজন টিআর, কাবিখা, কাবিটা, কর্মসৃজন প্রকল্পে ভাগ-বাটোয়ারাসহ টেন্ডারবাজি, হাটবাজার, বালুমহল ইজারা, দখলসহ সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করছেন।
আবার উপজেলা আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, মহিলা লীগসহ বিভিন্ন সহযোগী সংগঠনের শীর্ষ পদে বসিয়েছেন ভিন্ন দল থেকে আসা বিতর্কিতদের, আত্মীয়-স্বজনদের। যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও বঞ্চিত করা হয়েছে ত্যাগী ও পুরনো পরীক্ষিত-কর্মীদের। জরিপে এরকম দশ ধরনের অভিযোগ শতাধিক সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে উঠে এসেছে। অভিযোগ রয়েছে, বর্তমান এমপিদের মধ্যে কেউ কেউ হত্যা, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির দায়ে জেলে গেছেন। আবার কারো বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন।
নির্বাচনী এলাকায় দলীয় নেতাকর্মীদের বাদ দিয়ে ‘এমপি লীগ’ গঠন করেছেন কেউ কেউ। এর ফলে কোণঠাসা হয়ে পড়ছে দলের ত্যাগী নেতাকর্মীরা। যার কারণে অনেকে দলীয় কর্মসূচিতে অংশ না নিয়ে নিষ্ক্রিয় রয়েছেন। এর প্রভাব আগামী নির্বাচনে পড়তে পাড়ে।
এদিকে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় সাংগঠনিক ও প্রশাসনিক জরিপ দফায় দফায় পরিচালনা করা হচ্ছে। এসব জরিপ প্রতিবেদনে বর্তমান এমপিদের ভালো ও মন্দ কাজের পর্যালোচনা করেই আগামী নির্বাচনে প্রার্থী মনোনয়ন চূড়ান্ত করা হবে। ইতোমধ্যে পরিচালিত একাধিক জরিপ রিপোর্ট দলের হাইকমান্ডের হাতে রয়েছে। প্রতিটি রিপোর্ট পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা করা হচ্ছে।
তবে এলাকায় জনপ্রিয় এমপিরা যাতে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে বাদ না পড়ে সেটিও হাইকমান্ডের বিবেচনায় রয়েছে। পাশাপাশি ওই এলাকার অবস্থা, অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশীদের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি, এলাকায় তাদের ইতিবাচক এবং নেতিবাচক দিকগুলো খতিয়ে দেখা হচ্ছে। বিতর্কিত এমপিদের স্থলে এবার নতুন মুখ দেখা যেতে পারে বলে জানা গেছে।
ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিভিন্ন সভা-সমাবেশে আগামী নির্বাচনে কোন ধরনের প্রার্থী দলের পছন্দ সেটা বারবার বলে আসছেন। কোনো ধরনের বিতর্কিত ভাবমূর্তির কোনো জনপ্রতিনিধিকে এবার মনোনয়ন দেয়া হবে না সেটাও প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের হাইকমান্ড গত এক বছর ধরে প্রার্থী বাছাই নিয়ে কাজ শুরু করেছেন। তারই অংশ হিসেবে বিতর্কিত অনেককে ডেকে এনে সংশোধন হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন হাইকমান্ড। এরপরেও যারা সংশোধন হননি তাদের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়া হবে বলে সূত্র জানায়।
আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বোর্ডের দু’জন সদস্য জানান, গত বছর দলের ২০তম জাতীয় সম্মেলনের মাধ্যমে কমিটি গঠনের পর সাংগঠনিক সম্পাদকরা জেলায় জেলায় সফর করছেন। এ সময় স্থানীয় জনগণ ও দলীয় নেতাকর্মীদের মধ্যে বর্তমান এমপিদের অবস্থান সম্পর্কিত তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। বর্তমান এমপিদের পাশাপাশি সম্ভাব্য প্রার্থীদের অবস্থান সম্পর্কেও তথ্য নেওয়া হচ্ছে। তারা হাইকমান্ডের কাছে সে তথ্য জমা দিয়েছেন।
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল আলম হানিফ ইত্তেফাককে জানান, যারা নিজেদের কর্মকাণ্ডের কারণে জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ও গ্রহণযোগ্যতা হারিয়েছেন তাদের আগামী নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন পাওয়ার সম্ভাবনা কম।
কৃতজ্ঞতা-দৈনিক ইত্তেফাক