ক্যালেন্ডারের গোড়ার কথা

                             

সুপ্রাচীন কাল থেকেই সূর্যকে সর্বোচ্চ আসনে বসিয়েছে মানুষ। সূর্য আমাদেরকে আলো দেয়, উত্তাপ দেয়। সূর্য আছে বলেই গাছপালা জন্মায়। সূর্যের ভয়ঙ্কর তাপে আবার খরাও হয়। যার পরিণাম অনাহার ও মৃত্যু। এইসব কারণেই আদি যুগের মানুষরা সর্বশক্তিমান ঈশ্বরের আসনে বসিয়েছিল সূর্যকে।

অন্ধকারে আলো দেয় চাঁদ, সেই চাঁদের সঙ্গে জোয়ারের সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছিল প্রাচীন যুগের মানুষরা। এই চাঁদকেও তখন তারা দেবতার আসনে বসায়। ধীরে ধীরে তারা এই চাঁদ ও সূর্যের উদয় ও অস্তের মধ্যে একটা নিয়ম দেখতে পায়।

আবর্তনের নির্দিষ্ট এক পদ্ধতি আছে এই ধরনের প্রশ্ন দেখা দিয়েছিল প্রাচীন মানুষের মনে। তারা হয়তো ভেবেছিল, আবর্তনের নির্দিষ্ট ছকের হিসাব বের করতে পারলে আগে থেকেই জানা যাবে খুব শীত পড়বে কখন, কখনই বা দারুণ গরম। শস্যবীজ রোপণ করার সঠিক সময়ই বা কখন। এসব আগে থেকে জানতে পারলে চাষের কাজে সুবিধা হয় অনেকখানি।

খুব স্বাভাবিক কারণেই প্রাচীন যুগের মানুষের জ্ঞানের পরিধি তেমন বিস্তৃত ছিল না। তাদের ধারণা ছিল, সূর্য পৃথিবীর চারদিকে ঘোরে। অবশেষে ষোড়শ শতকে বিখ্যাত পোলিশ জ্যোতির্বেত্তা কোপারনিকাস নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেন। বিশ্বের কেন্দ্রে সূর্যের অবস্থান। পরবর্তী কালে গ্যালিলিও, আইজ্যাক নিউটন প্রমুখ জ্যোতির্বেত্তার সুবাদে সূর্য, চন্দ্র, পৃথিবীর গতি, অবস্থান ইত্যাদি সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা তৈরি হল মানুষের। পৃথিবী পরিভ্রমণ করে দু’ভাবে। প্রথমে এটি এর অক্ষরেখায় ঘোরে। ঠিক ঘুরন্ত লাট্টুর মত। পরিক্রমণ সম্পূর্ণ হয় প্রতি চব্বিশ ঘন্টায় এক বার। পরিক্রমার সময় সূর্যের আলো ও অন্ধকার পরে পৃথিবীর গায়ে পালা করে। সেই হিসেবে দিন ও রাত নামে পৃথিবীতে। পরিক্রমণের দ্বিতীয় পথটি অন্যরকম। পৃথিবী সূর্য প্রদক্ষিণ করে বিশেষ এক কক্ষপথে। এই প্রদক্ষিণ সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে এক বছর (৩৬৫ দিন ও রাত)। পৃথিবীর অক্ষরেখা সামান্য বাঁকানো। তার ফলে, যারা উত্তর গোলার্ধে থাকে (পৃথিবীর ওই অংশ নিরক্ষবৃত্তের উত্তরে রয়েছে) তাদের কাছে গ্রীষ্মকাল জুন থেকে আগষ্ট। ওই সময় পৃথিবীর ওই অংশ সূর্যের খুব কাছে থাকে। রাতগুলি তখন বেশ ছোট, দিনের আকার বড়। দীর্ঘতম দিনটি পাওয়া যায় ২১ জুন। উত্তর মেরুতে মধ্যগ্রীষ্মে অস্তই যায় না সূর্য।

পৃথিবীর অপর প্রান্ত দক্ষিণ গোলার্ধ (পৃথিবীর ওই অংশ নিরক্ষবৃত্তের দক্ষিণে)। ওখানে অষ্ট্রেলীয়রা শীত পায় জুন মাসে। কারণ ওই সময় পৃথিবীর ওই অংশ সূর্যের বিপরীত প্রান্তে ঝুঁকে পড়ে বেশ কিছুটা। দক্ষিণ মেরুর যত কাছাকাছি থাকবে জুন মাসের রাতগুলি তত দীর্ঘ হবে। বছরের ওই সময়ে দক্ষিণ মেরুতে দিন বলে কিছু থাকে না।

চাঁদও নির্দিষ্ট কক্ষপথে পৃথিবী পরিক্রমা করে। পরিক্রমা সম্পূর্ণ হতে সময় লাগে ২৯.৫ দিন। প্রস্তর যুগ শেষ হওয়ার মুখে গ্রহ-নক্ষত্রের এত সব জটিলতার হদিস পায়নি মানুষ। কিন্তু প্রকৃত তথ্য জানার জন্য তাদের অনুসন্ধান থেমে থাকে নি কখনও। সূর্যের গতিপথ ইত্যাদি সম্পর্কে জ্ঞান আহরণ করার জন্য সে আমলে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডে উঁচু-উঁচু মিনার বানানো হয়েছিল। ওইসব গবেষণায় ধীরে ধীরে লাভবান হল মানুষ। ফসল ফলানোর সময় ঠিক সময় হিসেব কষে বার করে ফেলল তারা।

নীল নদের ধারে বাস করতে করতে মিশরীয়রা যে তিনটি বিষয়ে প্রথমে জ্ঞান অর্জন করেছিল- সেগুলি হল: বন্যা, বীজ বোনা ও ফসল ফলানোর সময়। কিন্তু এই জ্ঞানটুকুই যথেষ্ট নয়। আগে থেকে হিসেব কষে বার করতে হতো নীল নদে বান আসে কখন। সুতরাং আড়াই হাজার বছর আগে ক্যালেন্ডার তৈরির কাজে লেগে পড়েছিল তারা।

হিসেব করে বার করেছিল- কক্ষপথে সূর্য পরিক্রমায় পৃথিবীর সময় লাগে প্রায় ৩৬৫ দিন। বছরকে ভাগ করা হয়েছিল বারো মাসে। প্রতি মাসে দিনের সংখ্যা ত্রিশ। নতুন চাঁদের উদয়কাল থেকে প্রতি মাসের সূত্রপাত ধরা হত। প্রতি বছরের শেষে উদ্বৃত্ত থাকত পাঁচটি দিন। এই দিনগুলি ছিল বিশেষ ভোজের দিন।

মধ্য আমেরিকায় মায়া ও মেক্সিকানরাও আবিষ্কার করেছিল যে, সূর্য প্রদক্ষিণ করতে পৃথিবীর প্রায় ৩৬৫ দিন সময় লেগে যায়। কিন্তু তারা মোট সময়কে আঠারো মাসে ভাগ করেছিল। প্রতি মাসে দিনের সংখ্যা কুড়ি। ‘বাড়তি’ পাঁচ দিনকে অশুভ বলে ধরা হত। দু’হাজার বছরেরও আগে চিনারা তাদের ক্যালেন্ডার তৈরি করেছিল। প্রতি মাসে ত্রিশ দিন। বাড়তি পাঁচ দিন জমতে জমতে ত্রিশ হয়ে উঠলে ওদের ক্যালেন্ডারে একটি ‘ত্রয়োদশ মাস’ এর আবির্ভাব হত।

শুধু বছরকেই নয়, দিনকেও চিনারা বারোটি সমান ভাগে ভাগ করেছিল। বারোর আলাদা আলাদা দলে দিন ও বছরকে ভাগ করে দিন ও বছরের বিভিন্ন নামকরণ করেছিল তারা। প্রাণীর নামে নাম। যেমন ইঁদুর, ষাঁড়, বাঘ, খরগোশ, ড্রাগন, সাপ, ঘোড়া, ভেড়া, বাঁদর, মোরগ, কুকুর ও শুয়োর। এদের নামে বিভিন্ন ঘন্টা, দিন, মাস ও বছরের নাম নির্দিষ্ট। ১৯৮৯ সালটি চিনাদের কাছে ‘সর্পবর্ষ’ হিসেবে চিহ্নিত। বলা যেতে পারে, খ্রিষ্টপূর্ব ৭৫০ সাল নাগাদ রোমের ক্যালেন্ডারের উদ্ভব। উদ্ভাবক কিংবদন্তির সেই নায়ক ও রোমের প্রতিষ্ঠাতা রমুলাস। ওই ক্যালেন্ডারের হিসেবে বছরে দিনের সংখ্যা ছিল ৩০০। ওই দিনগুলি আবার ভাগ করা হয়েছিল দশ মাসে। প্রথম মাসের নাম ছিল মারটিয়াস (মার্চ)। যুদ্ধদেবতা মঙ্গলের নামে নাম। রোমানরা বিশ্বাস করত, ওই যুদ্ধদেবতাই ছিলেন রমুলাসের পিতা। পরবর্তীকালে আরেক সম্রাট নুমার নির্দেশে মাসের সংখ্যা বের করা হয়েছিল বারো।

খ্রিষ্টপূর্ব প্রথম শতকে বিখ্যাত জুলিয়াস সিজার একজন গ্রিক জ্যোতির্বেত্তার সাহায্য নিয়ে ক্যালেন্ডারের সংশোধন করেন। উদ্ভাবন হল ‘জুলিয়ান ক্যালেন্ডার’ এর। এই ক্যালেন্ডারের হিসেবে সূর্যের চারদিকে ঘুরতে পৃথিবীর সময় লাগে ৩৬৫ দিন। সেই হিসেবে বছরের দিনের সংখ্যা ধরা হল ৩৬৫। দিনের বাড়তি এক-চতুর্থাংশ জুড়ে প্রতি চতুর্থ বছরে বাড়তি একটি দিন ফেব্রুয়ারি মাসের সাথে যোগ করা হত। এই দিনটি ছিল ‘লিপ ডে’।

জুলিয়ান ক্যালেন্ডার কার্যকর ছিল বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে, তারপর এটি সংস্কারের প্রয়োজন দেখা দেয়। ১৫৭৭ সালে এই সংস্কার কাজে ত্রয়োদশ পোপ গ্রেগরিকে সাহায্য করেন দু’জন জ্যোতির্বেত্তা। ইউরোপের অধিকাংশ দেশ, এমনকি স্কটল্যান্ডও নতুন ধারার ‘গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার’ কে মেনে নেয়। কিন্তু ইংরেজরা ১৭৫১ সালের আগে পর্যন্ত এটিকে মানে নি। মানাবার জন্য অবশেষে আইন প্রণয়ন করে পার্লামেন্ট। ইতিমধ্যে জুুলিয়াস সিজারের হিসেবের সময় কমতে কমতে এগারো দিন পিছিয়ে গিয়েছিল। সুতরাং ওই এগারো দিন যোগ করা হল নতুন ক্যালেন্ডারে। স্থির করা হল, ১৭৫২ সালের ২ সেপ্টেম্বরের পরের তারিখটিই হবে ১৪ সেপ্টেম্বর। খবরটি শুনে জনতার মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়েছিল। কেউ কেউ রব তুলেছিল “ফিরিয়ে দাও আমার এগারো দিন”। ওই একই আইনের সুবাদে বছর শুরুর তারিখ ২৫ মার্চের বদলে হয় ১ জানুয়ারি। যুক্তরাজ্যে আর্থিক বছরের হিসেব অবশ্য পুরোনো নিয়মেই থেকে গেল, অর্থাৎ মার্চেই বছরের শেষ। ভারতেও চালু আছে নিয়মটি। ১৭৯৩ সালে প্রথম ফরাসি প্রজাতন্ত্র ক্যালেন্ডার পুরোপুরি পাল্টে দেয়ার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু ওই প্রজাতন্ত্রের মতোই স্বল্পমেয়াদি ছিল পরিবর্তিত ক্যালেন্ডারটি। নেপোলিয়ন সম্রাট হওয়ার পরে ১৮০৬ সালের ১ জানুয়ারি থেকে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার ফিরিয়ে আনেন আবার। ১৯১২ সালে চিনারাও এই ক্যালেন্ডারটিকে মেনে নেয়, তবে বিভিন্ন বছরের পুরানো সেই নামগুলি তারা বজায় রেখেছে এখনও।

রুশ বিপ্লব পর্যন্ত রাশিয়া, গ্রিস ও তুরস্কে প্রাচীন ক্যালেন্ডার অনুসরণ করা হত। ওই ক্যালেন্ডারের হিসেবে ইউরোপের অন্যান্য দেশের তুলনায় সময় ১২ দিন পিছিয়ে ছিল। ফলে ১৯১৭ সালের ‘অক্টোবর বিপ্লব’ এর কিছু ঘটনা নভেম্বরে ঘটেছে। এখন অবশ্য অধিকাংশ দেশেই গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার স্বীকৃত। তবে ইহুদি ও মুসলমানরা ধর্মীয় ব্যাপারে এখনও তাদের নিজস্ব ক্যালেন্ডার অনুসরণ করে থাকে।

শেয়ার করুন