বিশ্বের সর্বোচ্চ ভাস্কর্য স্থাপনের গৌরব এখন ভারতের দখলে। দেশটির সাবেক বর্ষীয়ান রাজনৈতিক নেতা ও প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী সরদার বল্লভভাই প্যাটেলের ভাস্কর্যটি ১৮২ মিটার (৫৯৭ ফুট) উঁচু, যা প্রায় ৬০ তলা ভবনের সমান উঁচু। এর নামকরণ হয়েছে ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’। জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে এটি নির্মাণ করা হয়েছে।
ভারতের গুজরাট রাজ্যের সাদু বেট আইল্যান্ডে নর্মদা নদীর পাশে ভাস্কর্যটি নির্মিত হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে উঁচু এই ভাস্কর্য দেশটির নতুন এক অনন্য নিদর্শন। এটি বহুল আলোচিত যুক্তরাষ্ট্রের স্ট্যাচু অব লিবার্টির প্রায় দ্বিগুণ। সেনাবাহিনীর সঙ্গে তিন হাজারের বেশি শ্রমিক এটি নির্মাণে কাজ করেন। স্বনামধন্য নির্মাণ ও প্রকৌশল কোম্পানি লারসেন অ্যান্ড টাউবরোর (এলঅ্যান্ডটি) ৩০০ প্রকৌশলী এই মানবমূর্তি নির্মাণের সঙ্গে ছিলেন। অনেক অপেক্ষা ও উত্তেজনার পর কাল বুধবার স্ট্যাচু অব ইউনিটি উদ্বোধন করবেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। সরদার প্যাটেলের ১৪৩তম জন্মবার্ষিকীর এই বিশেষ দিনে তাঁর স্মরণে নির্মিত মূর্তিটি উন্মোচন করা হচ্ছে।
সরদার বল্লভভাই প্যাটেল ভারতীয় ব্যারিস্টার ও কূটনীতিক ছিলেন। তিনি সরদার প্যাটেল নামেই বেশি পরিচিত ছিলেন। ভারতীয় ন্যাশনাল কংগ্রেসের এই জ্যেষ্ঠ নেতা দেশটির স্বাধীনতা আন্দোলনে ভূমিকা রাখেন। ১৯৪৭ সালে ভারত স্বাধীন হওয়ার পর তিনি প্রথম উপপ্রধানমন্ত্রী হন। তিনি ১৮৭৫ সালে মুম্বাইতে জন্মগ্রহণ করেন। বর্ণাঢ্য কর্মজীবন শেষে সরদার প্যাটেল ১৯৫০ সালে ১৫ ডিসেম্বর শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন।
ইন্ডিয়া টুডের প্রতিবেদনে জানানো হয়, ২০১০ সালে গুজরাটের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ভাস্কর্যটি নির্মাণের ঘোষণা দেন। আট বছর পর এবার সেই ভাস্কর্য দৃশ্যমান হলো। এ জন্য গুজরাটের বর্তমান মুখ্যমন্ত্রী বিজয় রুপানি ও মুখ্যসচিব জে এন সিং ভাস্কর্য নির্মাণে নিয়োজিত থাকা হাজার হাজার শ্রমিক ও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে সাধুবাদ জানিয়েছেন।
সরদার বল্লভভাই প্যাটেল রাষ্ট্রীয় একটা ট্রাস্টের (এসভিপিআরইটি) মাধ্যমে নরেন্দ্র মোদির তত্ত্বাবধানে ২০১১ সালে সব কটি রাজ্যের ১ লাখ ৬৯ হাজার গ্রামের প্রায় ১০ কোটি কৃষক ১২৯ টন লোহার সরঞ্জাম সরবরাহ করে ভাস্কর্য নির্মাণে অবদান রাখেন। সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রতীকী এই অবদান দিয়ে সরদার প্যাটেল স্ট্যাচুর ভিত্তি নির্মাণ করা হয়।
এসভিপিআরইটিয়ের কর্মকর্তা ও সদস্য কে শ্রীনিবাসন বলেন, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ভিশন তাঁর স্লোগান ‘এক ভারত, শ্রেষ্ঠ ভারত’ স্ট্যাচু অব ইউনিটির মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত হয়েছে। এই স্থাপত্যের মাধ্যমে সংগঠিত ইন্ডিয়ার সরদার প্যাটেলের আদর্শই তুলে ধরা হয়েছে।
গুজরাট সরকারের অর্থায়নে স্ট্যাচু প্রকল্পের ব্যয় ৩ হাজার ৫০ কোটি রুপি। ভাস্কর্যটির পুরোদমে কাজ শুরু হয়েছিল ২০১৫ সালের মে মাসে। সাড়ে তিন বছর ধরে কাজ করে এর নির্মাণকাজ সম্পন্ন হয়। সরদার প্যাটেলের ১৯৪৯ সালের বাস্তব জীবনের আলোকচিত্র থেকে স্ট্যাচু অব ইউনিটি তৈরি করা হয়। যে ছবিতে প্যাটেলকে ধুতি ও জ্যাকেট পরা অবস্থায় দেখা যায়। বিশাল এই ভাস্কর্যের শিল্পী হলেন পদ্মভূষণ পুরস্কার বিজয়ী রাম ভি সুতার।
ভাস্কর্যটি তিন স্তরবিশিষ্ট কাঠামোয় বিন্যস্ত। অভ্যন্তরীণ স্তরে ১২৭ মিটার দুটি উঁচু টাওয়ার আছে, যা ভাস্কর্যের বুক পর্যন্ত বিস্তৃত। দ্বিতীয় স্তরটি স্টিলের কাঠামো এবং তৃতীয় স্তর বা ভাস্কর্যের উপরিভাগ আট মিলিমিটার ব্রোঞ্জ দিয়ে মোড়ানো। ভাস্কর্যের আপাদমস্তক দর্শনের জন্য দুটি লিফট আছে। প্রতি লিফট ২৬ জন বহন করতে পারে। লিফটে আধা মিনিটের মধ্যে ভাস্কর্যের শীর্ষ স্থানে পৌঁছানো সম্ভব। উচ্চতার দিক থেকে এর আগে সর্বোচ্চ স্ট্যাচুর রেকর্ড ছিল চীনের। স্প্রিং টেম্পল অব বুদ্ধ নামের স্ট্যাচুটির উচ্চতা ১৫৩ মিটার। বর্তমানে সেই অবস্থান নিল ভারতের স্ট্যাচু অব ইউনিটি। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে জাপানের ১২০ মিটার উঁচু উশিকু দায়বাসু, চতুর্থ স্থানে যুক্তরাষ্ট্রের ৯৩ মিটার উঁচু স্ট্যাচু অব লিবার্টি এবং পঞ্চম স্থানে রয়েছে রাশিয়া ৮৫ মিটার উঁচু হোমল্যান্ড মাদার।
যেভাবে ভাস্কর্যটি নির্মিত
প্রথমে এলঅ্যান্ডটি কোম্পানি ১৯৪৯ সালের প্যাটেলের একটি আলোকচিত্রকে ভিত্তি হিসেবে নেয়। আলোকচিত্রটির অনুরূপ ১৮ ফুট উঁচু ব্রোঞ্জের ভাস্কর্য তৈরি করেন ভাস্কর রাম ভি সুতার। সেই ভাস্কর্য প্যাটেলের জন্মস্থান গুজরাটের আনন্দ জেলার কারামাসাদে নিয়ে জনসমক্ষে প্রদর্শন করা হয়। মূলত, প্যাটেলের বাস্তব জীবনের সঙ্গে ভাস্কর্যের মিল আছে কি না, সেটা যাচাইয়ে স্থানীর জনতার মতামত ও পরামর্শের জন্য এটি করা হয়েছিল। জনতার প্রতিক্রিয়া মূল্যায়ন করে রাম সুতার ৩০ ফুট উচ্চতার ভাস্কর্য নির্মাণ করেন। বিভিন্ন গোষ্ঠীর পরামর্শে সেটাই চূড়ান্ত করা হয়। ভাস্কর্যে ব্যবহৃত ব্রোঞ্জের কাজ করেছে চীনের জিয়াংজি টোকাইন কোম্পানি (জেটিকিউ)।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা ও এলঅ্যান্ডটির কোম্পানির কর্মকর্তাদের সঙ্গে রাম সুতার চীনে গিয়ে জেটিকিউয়ের কাজ পর্যবেক্ষণ করেন। এই কাজের জন্য চারবার চীনে যেতে হয় সুতারকে। বিভিন্ন সাইজের প্রায় সাত হাজার প্লেট ভাস্কর্যটিতে স্থাপন করা হয়েছে। এসব কাজ পর্যবেক্ষণে ছিলেন এলঅ্যান্ডটি প্রকল্পের পরিচালক মুকেশ রাভাল। তিনি বলেন, কাজটি ছিল চ্যালেঞ্জের। প্রতি সপ্তাহে কাজের অগ্রগতির প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রী মোদি, মুখ্যমন্ত্রী রুপানি ও উপমুখ্যমন্ত্রী নিতিন প্যাটেলের কাছে পাঠানো হতো। প্রকল্পটির ইনচার্জ ইঞ্জিনিয়ার জয়প্রকাশ নাভিক বলেন, ‘এটা ছিল স্বপ্নের প্রকল্প এবং বিশাল চ্যালেঞ্জ। এর আগে এত বড় ভাস্কর্য নির্মিত হয়নি। ফলে এর কোনো সুনির্দিষ্ট পদ্ধতি ছিল না। দিন দিন পদ্ধতি পরিবর্তন হয়েছিল। শেষ পর্যন্ত কোনো দুর্ঘটনা ছাড়াই আমাদের লক্ষ্য বাস্তবায়ন হয়েছে।’
দর্শনার্থীদের জন্য যা থাকছে
সরদার প্যাটেল ভাস্কর্যের নিচ থেকে ২৫ মিটার উঁচু বা আটতলার উঁচু সমস্থানে ৪ হাজার ৭৪৭ স্কয়ার মিটার আয়তনের প্রদর্শনী হল ও চলচ্চিত্র কেন্দ্র আছে। যেখানে প্যাটেলের জাতীয় জীবনের কৃতিত্ব চিত্রায়িত করা হবে। এটি খুব শিগগির বড় পর্যটন কেন্দ্র হবে। এই স্ট্যাচু ও এর আশপাশের পাহাড়ি বনাঞ্চল পর্যটকদের আকর্ষণ করবে বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা মনে করছেন। ভাস্কর্য আরোহণে দুটি লিফটের মধ্যে একটি ১৩৫ মিটার উঁচুতে উঠবে। ছিন্দ্রযুক্ত জানালার সঙ্গে আছে চিত্তাকর্ষক গ্যালারি। প্রতিদিন ভাস্কর্যটি পরিদর্শনে তিন হাজার দর্শনার্থীকে অনুমতি দেওয়া হবে।
স্ট্যাচুর পাদদেশে আছে ভ্রমণকারীদের জন্য হাঁটার পথ, ফুট কোর্ট, বড় বাজার ও অতিথিদের থাকার ব্যবস্থা। স্ট্যাচুর অদূরে থ্রি স্টার হোটেল ও সেখানে ৫২টি কক্ষ আছে। ২৬৪ আসনের ক্যাফেটেরিয়া ও একটি গিফট শপ আছে। এ ছাড়া ৮০০টি গাড়ি পার্কিংয়ের সুব্যবস্থা। স্ট্যাচু অব ইউনিটি ঘিরে বিপুল পর্যটক আকর্ষণ করতে মোদি সরকারের পরিকল্পনা আছে। ভাদোদারা থেকে ৯০ কিলোমিটার ফোর লেন সড়ক নির্মাণ করা হচ্ছে। পর্যটকেরা আকাশপথে বা রেলপথে ভাদোদারা পৌঁছে যেতে পারবেন। পরে সেখান থেকে ব্যক্তিগত গাড়ি, ভাড়া করা গাড়ি কিংবা বাসে করে ওই ভাস্কর্যস্থলে যেতে পারবেন।
নতুন সম্ভাবনা
ভাস্কর্যটির পাশে পাহাড়ি এলাকায় সবুজঘেরা বনাঞ্চল। সেখানে উপজাতি সম্প্রদায়ের বসবাস আছে। দুঃসাহসিক পর্যটনের জন্য ওই এলাকাকে ব্র্যান্ডিংয়ের পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। স্ট্যাচু–সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, স্ট্যাচুকে কেন্দ্র করে সরাসরি দুই হাজারজন ও পরোক্ষভাবে পাঁচ হাজারজনের কাজের সুযোগ সৃষ্টি হচ্ছে। স্ট্যাচু নিয়ে জাতীয় ভিশনের অংশ হিসেবে গুজরাট সরকার ওই এলাকায় রেস্ট হাউস নির্মাণের জন্য অন্য রাজ্যগুলোকে ভূমি অধিগ্রহণ দেওয়ার প্রস্তাব করেছে। এরই মধ্যে উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ ভূমি অধিগ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন।