ভারতের সদ্যপ্রয়াত সাবেক প্রধানমন্ত্রী অটল বিহারী বাজপেয়ী যে সাড়ে ছয় বছর দিল্লির ক্ষমতায় ছিলেন- তার মধ্যে মোটামুটি অর্ধেকটা সময় তিনি ঢাকাতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার ও বাকি অর্ধেকটা খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে একটি বিএনপি জোট সরকারকে পেয়েছিলেন। তার প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ই চালু হয়েছিল ঢাকা-কলকাতা বাস পরিসেবা, আবার রৌমারী-পদুয়া সীমান্তে ১৬ জন বিএসএফ জওয়ান নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে যে সংঘাত- সেটাও ঘটেছিল বাজপেয়ীর আমলেই। আবার ২০০১ সালের অক্টোবরে ঢাকাতে বিএনপি ক্ষমতায় আসার পর নানা কারণে দুই দেশের সম্পর্কে চরম অবনতিও লক্ষ্য করা গিয়েছিল।
অটল বিহারী বাজপেয়ী যখন প্রধানমন্ত্রী, তখন বেশ কয়েক বছর ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের স্ট্যান্ডিং কমিটির চেয়ারপার্সন ছিলেন তৃণমূল কংগ্রেসের এমপি কৃষ্ণা বোস। সাবেক এই প্রবীণ পার্লামেন্টারিয়ান অবশ্য মনে করেন, বাজপেয়ীর আমলে ভারত-বাংলাদেশের মধ্যে বেশ কিছু ঘটনা হয়তো ঘটেছে- কিন্তু তিনি দুই দেশের সম্পর্কে কখনও তিক্ততা আনতে দেননি। বস্তুত রৌমারী-পদুয়া সীমান্তে ভারতের ১৬ জন বিএসএফ জওয়ান নিহত হওয়ার পরও ভারত যে কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নেয়নি, এটাকেও অনেকে বাজপেয়ীর সেই ‘সংযমে’র প্রমাণ বলেই মনে করেন।
তবে বাজপেয়ীর আমলে ভারতে পররাষ্ট্র সচিবের দায়িত্ব পালন করা শশাঙ্ক মনে করেন, প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সুসম্পর্ক বজায় রাখার ক্ষেত্রে তার কিছু দায়বদ্ধতাও ছিল— আর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কেও তার প্রভাব পড়েছে। বাজপেয়ী প্রতিবেশীদের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে একটা বাড়তি উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এমনকি বাংলাদেশে যে খালেদা জিয়া সরকারের সঙ্গে তার সরকারের মোটেও ভালো সম্পর্ক ছিল না, ব্যক্তিগত স্তরে সেই বেগম জিয়ার সঙ্গেও তিনি অত্যন্ত সৌজন্য আর ভদ্রতার সঙ্গে কথাবার্তা বলতেন। তবে অন্তত একটিবার অটল বিহারী বাজপেয়ীর সেই স্বভাবসুলভ ধৈর্য আর ভদ্রতারও বাঁধ ভেঙেছিল, সে আমলের কূটনীতিকরাই সে কথা জানাচ্ছেন।
২০০২ সালের গোড়ায় কাঠমান্ডুতে সার্ক শীর্ষ সম্মেলন। তার কিছু দিন আগেই বাংলাদেশে নির্বাচনের ঠিক পর পরই বেশ কিছু সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছিল, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু লোক মারাও গিয়েছিলেন। প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠকে ওই প্রসঙ্গ উত্থাপন করার সময় বাজপেয়ী কিন্তু বেশ উত্তেজিত হয়ে পড়েছিলেন।
ওই বৈঠকে হাজির থাকার সুবাদে নিজের চোখেই সে ঘটনা দেখেছেন বাংলাদেশের তদানীন্তন পররাষ্ট্রসচিব শমসের মোবিন চৌধুরী। তিনি বিবিসিকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ার জন্য বেগম জিয়াকে তিনি যেমন অভিনন্দন জানালেন, সেই সঙ্গেই কিন্তু বললেন আমি আশা করব একজন নির্বাচিত প্রধানমন্ত্রী হিসেবে আপনি আপনার দেশের সব ধর্মের লোকেদের সুরক্ষার ব্যবস্থা করবেন। শমসের মোবিন চৌধুরী আরো দাবি করছেন, ওই ঘটনার দুই বছর বাদে ইসলামাবাদ সার্ক শীর্ষ সম্মেলনে ‘বাংলাদেশে শান্তি ও সুস্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্য’ প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী খালেদা জিয়াকে অভিনন্দনও জানান। আমন্ত্রণ জানান দিল্লি সফরের।
তবে পর্যবেক্ষকরা মোটামুটি একমত যে, খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের আমলেই ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক তলানিতে ঠেকেছিল, আর সেই পাঁচ বছরের মধ্যে প্রায় তিন বছরই দিল্লির ক্ষমতায় ছিলেন অটলবিহারী বাজপেয়ী।
ভারতের সাবেক পররাষ্ট্র সচিব শশাঙ্ক বলেন, খালেদা জিয়ার আমলে উত্তর-পূর্ব ভারতের জঙ্গিরা যেভাবে বাংলাদেশে আশ্রয়-প্রশ্রয় পেতে শুরু করল, সেটা ছিল সম্পর্কে অবনতির একটা বড় কারণ। প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী অবশ্য তার পরও খালেদা জিয়ার সঙ্গে কথাবার্তা চালানোর চেষ্টা চালিয়ে গেছেন। সমস্যা হয়েছিল দুটো জায়গায়। এক, খালেদা জিয়া জামায়াতের মতো শরিকদের সঙ্গ ছাড়তে রাজি ছিলেন না। আর দুই, তার একদল উপদেষ্টা তাকে বুঝিয়েছিল ভারতের মতো বড় দেশকে চাপে রাখতে বাংলাদেশের উচিত হবে পরেশ বড়ুয়ার মতো জঙ্গি নেতাদের ঢাকায় আশ্রয় দেওয়া। দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে এই ধরনের অস্বস্তি থাকা সত্ত্বেও অটলবিহারী বাজপেয়ী অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে রীতিমতো উদারতা দেখিয়েছেন এবং বহু ছাড় দিয়েছেন বলেও জানান সাবেক এই ভারতীয় কূটনীতিবিদ।-বিবিসি বাংলা।