‘নো, ফলস কেস। নো, নেভার, ফলস কেস। এটা হতে পারে না।’ আসামিপক্ষের ক্ষুব্ধ আইনজীবীরা সমস্বরে এই চিৎকার করতে করতে চেয়ার ছেড়ে সামনে এগোচ্ছেন। ততক্ষণে চেয়ারে বসা খালেদা জিয়াকে ঘিরে ফেলে নারী পুলিশের একটি স্কোয়াড। বিচারক এজলাস ছেড়ে খাসকামরায় চলে গেছেন। বিএনপির নেতারা হতাশায় বসে পড়েছেন। সংবাদকর্মীরা কোন দিকে, কার কাছে যাবেন তা নিয়ে হুড়োহুড়ি করছেন। সাজানো-গোছানো আদালতকক্ষ যেন প্রচণ্ড এক ঝাঁকুনিতে মুহূর্তে এলোমেলো হয়ে গেছে।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট দুর্নীতি মামলার রায় ঘোষণার পর এই ছিল আদালতকক্ষের চিত্র। গতকাল বৃহস্পতিবার অপরাহ্ণে বিশেষ আদালত-৫-এর বিচারক মো. আখতারুজ্জামান এই রায় ঘোষণা করেন। বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া, তাঁর ছেলে তারেক রহমানসহ ৬ জন এই মামলার আসামি। রায়ে খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়। অন্য ৫ আসামির প্রত্যেককে ১০ বছর করে কারাদণ্ড এবং সর্বমোট ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।
খালেদা জিয়াকে ২০০৭ সালের ৩ সেপ্টেম্বর তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার গ্রেপ্তার করে কারাগারে নেয়। তিনি ২০০৮ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মুক্তি পান। তারেক রহমানকে ২০০৭ সালের ৩ মার্চ গ্রেপ্তার করা হয়। ২০০৮ সালের ২০ নভেম্বর চিকিৎসার জন্য অনুমতি নিয়ে তিনি বিদেশে যান। ২০১২ সালের ৬ জুলাই বিদেশে অর্থ পাচারের মামলায় বিশেষ জজ আদালত তাঁকে খালাস দেন। পরে দুদক আপিল করলে খালাসের আদেশ বাতিল করে হাইকোর্ট তাঁকে ৭ বছরের কারাদণ্ড দেন। তারেক রহমান বিদেশ থেকে না ফেরায় তাঁর জামিন বাতিল করে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
গতকাল বেলা ১টা ৫২ মিনিটে খালেদা জিয়া আদালতকক্ষে প্রবেশ করেন। এ সময় দলীয় নেতা ও জ্যেষ্ঠ আইনজীবীরা তাঁর সঙ্গে কথা বলেন। খালেদার পরনে ছিল ধূসর রঙের ফুলপাতা ছাপের হালকা বাসন্তী রঙের শিফন শাড়ি ও অফ হোয়াইট রঙের শাল। প্রতিদিনের মতো তাঁর পাশে ছিলেন মহিলা দলের দুই নেত্রী। খালেদা জিয়ার আইনজীবীরা বলেন, রায় ঘোষণার পর খালেদা জিয়া তাঁদের শান্ত ও ঐক্যবদ্ধ থেকে আন্দোলন চালিয়ে যেতে বলেছেন।
বিচারক এজলাসে ওঠেন বেলা ২টা ১১ মিনিটে। বিচারক এজলাসে উঠে চারদিক দেখে নিয়ে প্রথমেই বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর লোক ছাড়া প্রাইভেট সিকিউরিটির (ব্যক্তিগত বা বেসরকারি নিরাপত্তা বাহিনী) কেউ আদালতকক্ষে না থাকলে ভালো হয়। এ সময় বেগম জিয়ার ব্যক্তিগত নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যরা আদালতকক্ষের বাইরে চলে যান। এরপর বিচারক রায় পড়তে শুরু করলে বেগম জিয়াকে দেখা যায় চোখ বন্ধ করে বসে থাকতে। রায় ঘোষণা শেষ হওয়া পর্যন্ত তিনি চোখ বুজেই ছিলেন।
‘এটা ৬৩২ পৃষ্ঠার রায়। তাই আমি এর সবটা পড়ব না। প্রধান অংশগুলো শুধু পড়ব’—এই বলে বিচারক রায় পড়া শুরু করেন। তিনি মামলার অভিযোগ, ধারা, রাষ্ট্রপক্ষ ও আসামিপক্ষের যুক্তিতর্কের প্রধান বিষয়গুলো পাঠ করেন। আসামিপক্ষ এই মামলায় মোট ১৩৯ বার সময় নিয়েছে এবং একাধিকবার মামলার বিভিন্ন বিষয় চ্যালেঞ্জ করে উচ্চ আদালতে যাওয়ায় বিচারকাজ বিলম্বিত হয়েছে বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
বিচারক এরপর ‘মামলার বিবেচ্য বিষয়’ হিসেবে ১১টি পয়েন্ট উল্লেখ করেন। এর মধ্যে রয়েছে খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকার সময় তাঁর কার্যালয়ের মুখ্য সচিব কামাল উদ্দিন সিদ্দিকী সোনালী ব্যাংকে ৫৪১৬ নম্বর হিসাবটি খুলেছিলেন কি না। সেই হিসাবে প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে ১২ লাখ ৫৫ হাজার মার্কিন ডলার জমা হয়েছিল কি না। প্রধানমন্ত্রীর তহবিল থেকে এই অর্থ ওই হিসাবে পাঠানোর অনুমতি দিয়ে খালেদা জিয়া রাষ্ট্রীয় কাজে বিশ্বাসভঙ্গ করেছেন কি না। ওই হিসাব থেকে জিয়া অরফানেজ ট্রাস্টে ২ কোটি ১০ লাখ ৭১ হাজার ৬৭১ টাকা স্থানান্তর হয়েছিল কি না। সেই টাকা বিভিন্ন সময় ভিন্ন ভিন্ন ব্যক্তির নামে এফডিআর করা হয়েছিল কি না। এই কাজ সম্পাদন এবং তাতে সহযোগিতা করায় আসামিরা মামলায় উল্লেখিত ধারায় (দণ্ডবিধির ৪০৯ ও ১০৯ এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ আইনের ৫(২)) অপরাধ করেছেন কি না।
বিচারক বলেন, এই বিবেচ্য বিষয়গুলো সম্পর্কে সাক্ষ্যপ্রমাণ এবং দুই পক্ষের যুক্তিতর্কের আলোকে দেখা যায় যে আসামিপক্ষ তাঁদের নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেননি। রাষ্ট্রপক্ষ তাঁদের অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এই কথা বলে বিচারক সংশ্লিষ্ট ধারায় আসামিদের বিভিন্ন মেয়াদে শাস্তি ঘোষণা করেন। প্রধান আসামি হওয়ায় ‘সামাজিক অবস্থান ও শারীরিক অবস্থা বিবেচনায়’ খালেদা জিয়াকে অন্য আসামিদের তুলনায় লঘু দণ্ড দেওয়া হয়েছে বলে বিচারক রায়ে উল্লেখ করেন।