বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশনের দেয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০২০ সালের জুন থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ঢাকায় প্রতিদিন ৩৯টি তালাকের ঘটনা ঘটেছে। ওই হিসাব অনুযায়ী, ২০১৯ সালের একই সময়ের তুলনায় ২০২০ সালে তালাকের পরিমাণ বেড়েছে। তবে তালাকের সাথে স্বামী-স্ত্রীর পাশাপাশি সবচেয়ে বেশি যারা প্রভাবিত হয় তারা হচ্ছে ওই পরিবারের সন্তানরা। কোনো পরিবারের বাবা-মায়ের মধ্যে তালাক হলেও ওই পরিবারের সন্তানের জিম্মা কার হবে। এ নিয়ে মুসলিম আইনেই বা কী বলা আছে?
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন, মুসলিম পারিবারিক আইন অনুযায়ী, প্রায় সব ক্ষেত্রে বাবা সন্তানের প্রকৃত আইনগত অভিভাবক। এই আইনের আওতায় সন্তানের অভিভাবকত্ব এবং জিম্মাদারিকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়। তবে সাধারণ ক্ষেত্রে সন্তানের দেখাশুনা, অভিভাবকত্ব এবং ভরণপোষণের বিষয়গুলো অভিভাবক ও প্রতিপাল্য আইন ১৮৯০ এবং পারিবারিক আদালত অধ্যাদেশ অনুযায়ী নিয়ন্ত্রিত হয়।
আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন, কোন দম্পতির মধ্যে তালাক হলে এবং তাদের সন্তান থাকলে ছেলে সন্তানের সাত বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের হেফাজতে থাকবে। আইনে এমনটাই বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে মায়ের অধিকার সবার আগে স্বীকৃত। তবে মুসলিম আইনে মা সন্তানের আইনগত অভিভাবক নন; আইনগত অভিভাবক বাবা। মা শুধু জিম্মাদার বা হেফাজতকারী।
তিনি বলেন, ছেলে সন্তানের ক্ষেত্রে যে সাত বছর সে মায়ের কাছে থাকবে তখন সে বাবার সাথে দেখা-সাক্ষাত করতে পারবে। মেয়ে সন্তানের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত সে মায়ের হেফাজতে থাকবে। এসময় বাবা তার সাথে দেখা করতে পারবেন। এই সময়ের পর সন্তানদের তার বাবা চাইলে নিয়ে যেতে পারে। তবে নির্দিষ্ট বয়সের পরও সন্তানের জিম্মাদারি যদি কোনো মা রাখতে চান তাহলে সেক্ষেত্রে তাকে আদালতে আবেদন করতে হবে।
মিতি সানজানা বলেন, অনেক সময় দেখা যায় যে, তালাক হলেও যদি বাবা-মায়ের মধ্যে তেমন সমস্যা বা বিতর্ক না থাকে তাহলে সেক্ষেত্রে সন্তানদেরকে যৌথ হেফাজতে দেয়া হয়। অর্থাৎ বাবা কিংবা মা দুজনেই চাইলে সন্তানদের রাখতে পারেন। সেক্ষেত্রে হয়তো মায়ের কাছে চার দিন আর বাবার কাছে তিন দিন বা তাদের সুবিধা মতো থাকতে পারে। তবে জিম্মাদারি বা হেফাজত নিয়ে যদি বিতর্ক তৈরি হয় তাহলে নির্দিষ্ট সময়ের পর অর্থাৎ ছেলে বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাত বছর আর মেয়েদের ক্ষেত্রে বয়ঃসন্ধি পর্যন্ত সময় পার হয়ে যাওয়ার পরও যদি মা নিজের হেফাজতে রাখতে চান, তখন তাকে আলাদাভাবে আদালতে আবেদন করতে হবে। এ ধরনের আবেদনের পর আদালত যে বিষয়টি বিবেচনায় নেয় সেটি হচ্ছে, সন্তানের কল্যাণের জন্য যেটা সবচেয়ে ভাল, সেটিই সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে আদালত।
আদালত সাধারণত চায় যে, হেফাজতের ক্ষেত্রে বাবা-মা দুজনেই থাকুক। তবে ধরে নেয়া হয় যে, মায়ের কাছেই সন্তানরা সবচেয়ে বেশি ভাল থাকবে। তবে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, মা যদি আর্থিকভাবে সচ্ছল না হয়, বা তার যদি আয় না থাকে তাহলে সেটি মামলাকে দুর্বল করে তোলে। “কোর্ট এখানে অনেক কিছুকে বিবেচনায় নেয়। যেমন ফাইনান্সিয়াল স্ট্যাবিলিটি সেটা বাবা-মা যার কাছেই থাকুক না কেন, এছাড়া অন্যান্য বিষয় যেমন ড্রাগ ইস্যুও বিবেচনায় নেয়া হয়,” বলেন মিতি সানজানা।
বাবা-মায়ের মধ্যে যদি কারো বিরুদ্ধে গুরুতর কোন অভিযোগ থাকে যেমন মাদকাসক্ত হওয়া কিংবা অপরাধমূলক কোন কর্মকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগ, তাহলে আদালত কখনোই তার কাছে সন্তানের জিম্মাদারি দিতে চায় না। তবে সন্তান বাবা কিংবা মা- যার সাথেই থাকুক না কেন, অপরপক্ষকে সন্তানের সাথে দেখা করা ও সময় কাটানোর অনুমোদন দেয়া হয় আদালতের পক্ষ থেকে। তবে এক্ষেত্রেও তার বিরুদ্ধে মারাত্মক কোন অভিযোগ আছে কিনা তা খতিয়ে দেখা হয়। গুরুতর অভিযোগ না থাকলে সপ্তাহে দুই দিন বা তিন দিন দেখা করতে পারে। তবে এটা পরিবার অনুযায়ী আলাদা হয়। তবে দেখা করার অনুমোদন থাকলেও যদি বাবা কিংবা মাকে দেখা করতে না দেয়া হয় তাহলে যাকে দেখা করতে দেয়া হচ্ছে না সে আবার বিষয়টি নিয়ে আদালতে যেতে পারেন।
বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মিতি সানজানা বলেন, হেফাজত বা জিম্মাদারি দেয়ার ক্ষেত্রে সন্তানের মতামতের গুরুত্ব সবসময়ই থাকে।