রোহিঙ্গার ভার আর নিতে পারছেনা কক্সবাজার

মিয়ানমার থেকে আসা রোহিঙ্গাদের বোঝা আর বইতে পারছে না সীমান্তবর্তী কক্সবাজার জেলা। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, গত ২৫ আগস্ট থেকে সাত সপ্তাহে প্রায় পাঁচ লাখ ৮২ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে।

সরকারের তথ্য অনুযায়ী, ২৫ আগস্টের আগে থেকে বিভিন্ন সময় মিয়ানমার থেকে অনুপ্রবেশ করে এ দেশে অবস্থান করা রোহিঙ্গার সংখ্যা ছিল চার লাখ। সে হিসাবে এরই মধ্যে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১০ লাখ অতিক্রম করার পথে রয়েছে। এর ফলে সৃষ্টি হয়েছে ভয়াবহ মানবিক সংকট।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে মিয়ানমার সরকার একদিকে রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেওয়ার ও রাখাইন রাজ্যে শান্তি ফিরিয়ে আনার কথা বলছে; অন্যদিকে দেশটির নিরাপত্তা বাহিনী ও স্থানীয় মিলিশিয়ারা মিলে রোহিঙ্গাদের দ্রুত দেশছাড়া করার চেষ্টা করছে। বাংলাদেশ এরই মধ্যে মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনে একটি চুক্তির খসড়া প্রস্তাব করেছে। এমন প্রেক্ষাপটে সীমান্ত কত দিন খোলা রাখা হবে, তা নিয়েও নানা চিন্তা-ভাবনা চলছে।

কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়া সীমান্তের নো ম্যানস ল্যান্ডে গত মঙ্গলবার থেকে অপেক্ষমাণ প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গা গতকাল বুধবার এ প্রতিবেদন লেখার সময়ও সেখানে ছিল। নাইক্ষ্যংছড়ি সদর ও তমব্রুতেও একই অবস্থা।

গতকাল বিকেলে এলাকাটি পরিদর্শন করে দেখা গেছে, পূর্বে নাফ নদতীরের বেড়িবাঁধে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে প্রবেশের অপেক্ষায় আছে।

ওই বেড়িবাঁধের পশ্চিমে উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমানপাড়ার ধানক্ষেত ও গ্রাম। বেড়িবাঁধ থেকে রোহিঙ্গারা এপারে আসতে চাইলে বিজিবি সদস্যরা বাধা দেন। সংবাদকর্মীরা সেখানে যেতে চাইলে বিজিবি সদস্যরা বাধা দিয়ে বলেন, সীমান্তে নিরাপত্তা ঝুঁকি আছে। এ কারণে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশে তাঁরা যেতে দিচ্ছেন না। অন্যদিকে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশে বাধা না দিলে সারা বছরই এ প্রবণতা অব্যাহত থাকবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘রোহিঙ্গারা এ দেশে আসায় আমাদের অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। আরো রোহিঙ্গা যাতে না আসে সে বিষয়টি নিরুৎসাহ করা হচ্ছে। ’

গতকাল সন্ধ্যায় কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমান পাড়ায় রোহিঙ্গা নারী সেতারা বেগম জানান, তিনি বাংলাদেশে এসেছেন ২৬ বছর আগে। বর্তমানে তিনি আছেন কুতুপালং শিবিরে। রাখাইনের বুচিদং থেকে বোনসহ ১৩ জন স্বজন এসে আটকা পড়েছে নাফ নদের তীরে। তিনি তাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছেন। দুপুর দেড়টা থেকে খাবার নিয়ে বসে রয়েছেন। কিন্তু সীমান্ত পেরিয়ে স্বজনদের কাছে যেতে বিজিবির অনুমতি মেলেনি। শেষ পর্যন্ত তিনি সন্ধ্যায় ফিরে যাচ্ছেন।

নুরুল ইসলাম (১৯) নামের এক রোহিঙ্গা দুই দিন আগে পরিবারের ১৪ সদস্য নিয়ে এসে আশ্রয় নিয়েছেন নাফ নদ তীরের নো ম্যানস ল্যান্ডে। রাখাইনের কুয়াইন্দং এলাকা থেকে টানা ১০ দিন হেঁটেছেন তাঁরা। তিনি জানান, কৌশলে মঙ্গলবার বেড়িবাঁধ থেকে তিনি বাংলাদেশে ঢোকেন। তিনি দুই দিন ধরে এমএসএফ নামের একটি এনজিওর কাজ করছেন।

নো ম্যানস ল্যান্ডেও মিলছে খাবার ও চিকিৎসা : নাফ নদ তীরের নো ম্যানস ল্যান্ডে অবস্থান নেওয়া প্রায় ২০ হাজার রোহিঙ্গাকে বিভিন্ন এনজিও খাবারসহ চিকিৎসাসেবা দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), এমএসএফ, রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন সংস্থা রোহিঙ্গাদের সেবায় নিয়োজিত রয়েছে।

সীমান্ত এলাকায় আবার হেলিকপ্টার : মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তের পালংখালীর যেখানে বাংলাদেশমুখী রোহিঙ্গারা অবস্থান নিয়েছে, সেখানেই গতকাল ৩টা ৫০ মিনিটে দেখা গেছে একটি সামরিক হেলিকপ্টার। সীমান্তের উত্তরের ঢেঁকিবনিয়া সেনাঘাঁটি থেকে সামরিক হেলিকপ্টারটি বাংলাদেশের সীমান্ত ঘেঁষে দক্ষিণে মংডুর দিকে উড়ে যেতে দেখা যায়। এ সময় হেলিকপ্টারটি অনেক নিচু হয়ে এবং নো ম্যানস ল্যান্ডের রোহিঙ্গাদের অবস্থানস্থলটির ওপর দিয়ে অত্যন্ত ধীরগতিতে পাড়ি দেয়।

মিয়ানমারের ড্রোন আসছে প্রতিদিন : পালংখালী সীমান্ত এলাকার বাসিন্দারা জানিয়েছে, প্রায় প্রতিদিনই মনুষ্যবিহীন আকাশযান (ড্রোন) উড়ে আসে বাংলাদেশ সীমান্তে। কদিন ধরে পালংখালী আঞ্জুমান পাড়া সীমান্ত এলাকায় ড্রোন উড়িয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষ রোহিঙ্গা ঢলের অবস্থানসহ বাংলাদেশ সীমান্তের চিত্র ধারণ করে বলে জানা গেছে। সীমান্তে দায়িত্বরত বিজিবি সদস্যরা মিয়ানমারের ড্রোন আসার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।

এলাকাবাসীর বিক্ষোভ : পালংখালী ইউনিয়নের আঞ্জুমান পাড়ার লোকজন গতকাল আকস্মিকভাবে বিক্ষোভ করেছে। রোহিঙ্গাদের কারণে গ্রামবাসীর ধানক্ষেত নষ্ট এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ও বিভিন্ন এনজিওর কাজে গ্রামের লোকজনকে নিয়োগ না দেওয়ার প্রতিবাদে তারা ওই বিক্ষোভ করে।

স্থানীয় বাসিন্দা সৈয়দুল বাশার জানান, তাঁর ১২ কানি (এক একরে আড়াই কানি) জমি বেড়িবাঁধসংলগ্ন জমি রয়েছে। কিন্তু সেখানে হাজার হাজার রোহিঙ্গা চলাচলে তাঁর ফসলের মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। তাঁর মতো আরো অনেক বাসিন্দাই এমন ক্ষতির শিকার।

বকতার আহমদ নামের এক স্থানীয় বাসিন্দার অভিযোগ, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তাদের দৈনিক কাজে রোহিঙ্গাদের নিয়োগ করলেও স্থানীয়দের নিয়োগ করা হচ্ছে না।

সীমান্তে মাদকবিরোধী অভিযান : মিয়ানমার-বাংলাদেশ সীমান্তে মাদকবিরোধী এক সাঁড়াশি যৌথ অভিযান শুরু হয়েছে। মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের পরিচালক (অপারেশন) সৈয়দ তৌফিক উদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে এই অভিযানে বিজিবি, র‌্যাব, পুলিশ, আনসার, জেলা প্রশাসন ও গোয়েন্দা সংস্থার কর্মীরা অংশ নিচ্ছেন। অভিযানে অংশ নেওয়া মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক নজরুল সিকদার জানিয়েছেন, রোহিঙ্গা ঢলের মধ্যে সীমান্তে ইয়াবাসহ মাদক চোরাচালানের খবর পেয়েই যৌথ অভিযান জোরদার করা হয়েছে।

কৃতজ্ঞতা- দৈনিক কালের কন্ঠ

শেয়ার করুন